ভালোলাগার শহর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি

অস্ট্রেলিয়ার কথা মনে হলে প্রথমেই চোখে ভাসে বিশ্ববিখ্যাত সিডনি অপেরা হাউস। আমরা ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন বইয়ে, পোস্টারে সিডনি অপেরা হাউসের ছবি দেখতাম।

দেবাশিস সরকার, অস্ট্রেলিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2018, 07:08 AM
Updated : 16 Sept 2018, 07:08 AM

১৫-২০ বছর আগে যখন এখনকার মতো মোবাইল ক্যামেরা ছিল না, তখন ছবি তুলতে হলে স্টুডিওতে যেতে হতো। আর স্টুডিওতে ছবি তোলার ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে বিভিন্ন দেশের কত সুন্দর সুন্দর ছবি থাকতো, দেখলেই মনে হতো যদি একবার যেতে পারতাম!

সিডনির অপেরা হাউসের ছবি এমনি এক বিখ্যাত ছবি। এটা প্রায় বেশিরভাগ স্টুডিওতে ব্যবহার করা হতো। আমার মনে হয় আপনাদেরও অনেকের এমন মনে হতে পারে। চলুন তাহলে আমার গল্পের মাধ্যমে আপনাদের নিয়ে যাই সিডনিতে।

সিডনি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের রাজধানী। প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের বসবাস এই সিডনিতে। সিডনি অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন এবং বড় শহর। অনেক ব্যয়বহুল শহর। প্রযুক্তির শহরও বলা চলে সিডনিকে। অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় কোম্পানির প্রধান অফিস সিডনিতে। বিশাল বিশাল বিল্ডিং দেখলেই বুঝা যায় যে সিডনি একটা ব্যবসায়িক শহর। মনে হচ্ছিলো যেন আমি নিউ ইয়র্কের রাস্তা ধরে হাঁটছি।

সামুদ্রিক মাছের বাজারের জন্যও সিডনি বিখ্যাত। নতুন বছরের আগমনে অপরূপ হয়ে সাজে সিডনি শহর। রাতে ফায়ারওয়ার্কসের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ সিডনি থেকে সরাসরি অথবা অনলাইনে এর সৌন্দর্য  উপভোগ করে।

বহুমুখি সংস্কৃতির শহর সিডনি। একদিকে চায়না মার্কেট, হাঁটলে মনে হবে চীন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অন্যদিকে হাঁটলে মনে হবে ইউরোপের রাস্তায় ঘুরছেন, অথবা কখনও ভিয়েতনাম গিয়ে থাকলে মনে হবে ভিয়েতনামিজ ভাষায় কেউ ডাকছে, আবার এমনও হতে পারে বাংলায় কেউ উঁচুস্বরে বলছে, “কিরে বন্ধু, কেমন আছিস?” বহু দেশ, বহু ভাষার মানুষ সিডনিতে মিলেমিশে থাকে। এ এক অদ্ভুত উদাহরণ সহনশীলতার।

 

আপনি বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি করে যেভাবে খুশি সিডনি ঘুরতে পারেন, কিন্তু আপনি যদি সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় (১৮৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে হাঁটা শুরু করেন, তাহলে মূল শহরটা দেখতে দেখতে একেবারে সিডনি অপেরা হাউসে গিয়ে পৌঁছাবেন।

হাঁটার জন্য রাস্তার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। হাঁটার মাঝে চায়না মার্কেট, বাংলাদেশের নিউ মার্কেটের মতো মার্কেট ঘুরে, কেনাকাটা করে, সুপার শপ থেকে কম দামে খাবার কিনে, রাস্তায় বসার জায়গায় বসে অথবা কোনো ফাস্টফুডের দোকানে বসে ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে করতে আপনি শহরের বড় একটা অংশ দেখতে দেখতে সিডনি অপেরা হাউসে চলে যেতে পারবেন।

তারপর বেড়ানো শেষ হলে অপেরা হাউসের খুব কাছে থেকেই ট্রেনে করে জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চলে যেতে পারবেন। সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা সিডনির অনেক সৌন্দর্যের একটি।

শহরের বিভিন্ন জায়গায় অনেক সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার আছে। আছে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। আপনি ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলে যেমন আরামে বসে বিশ্রাম নিতে পারবেন যেকোনো পার্কে, তেমনি লাইব্রেরিতে গিয়ে ইচ্ছেমতো বই পড়তে পারবেন।

জ্ঞানের শহর সিডনি। মানুষ যখনই ভ্রমণ করে বাসে কিংবা ট্রেনে, তখনই অনেকেই বই পড়তে থাকে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যদি কখনও মনে হয় বই পড়বেন, দেখবেন রাস্তাতেও ফ্রি গ্রন্থাগার রয়েছে। বই নিয়ে পড়ে আবার ওইখানে ফেরত দিতে পারবেন। যদি এমন হতো আমাদের দেশে রাস্তায় এরকম বইয়ের গ্রন্থাগার থাকতো?

 

সিডনিতে আসা মানেই সিডনি ডার্লিং হারবারে বেড়াতে আসা। এখানেই সিডনির অনেক বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানের অবস্থান। যেমন-সিডনি হারবার ব্রিজ, সিডনি অপেরা হাউস এবং এটা সংলগ্ন পার্ক। এখান থেকে হারবার ব্রিজের উপরে ভ্রমণ, বিমানে করে শহরের সৌন্দর্য দেখা যাবে। তবে এইগুলো ভ্রমণ করার জন্য আপনার বেশি সময় লাগবে না। কারণ এইসবের বেশিরভাগ স্থান হারবার কেন্দ্রিক।

 

১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সিডনি অপেরা হাউস পৃথিবীর অন্যতম এবং বিখ্যাত বিল্ডিং। সবসময়ই দেখি মানুষের ভিড়। মনে হচ্ছিলো সিডনি অপেরা হাউসকে মানুষ ভালোবেসে ঘুমাতে দেয় না। আমার ভাগ্য ভালো বলা চলে। অপেরা হাউসের ভেতরের দিকে গিয়েই দেখি বিয়ের আয়োজন। ভালোই লাগলো।

 

আরও ভালো লাগলো যখন দেখি আমাদের এশিয়ান লোকজন অপেরা হাউসের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। সুযোগ বুঝে একটু কথা বলে নিলাম। সিডনি অপেরা হাউসের ভেতরের সৌন্দর্য তো আরও সুন্দর। সময় থাকলে আপনি ভেতরে গিয়ে দেখতে পারেন।

 

তবে রাতের বেলা সিডনি অপেরা হাউস না দেখলে কেমন যেন একটা না দেখার তৃষ্ণা থেকে যায়। আমি রাতের বেলাতে বেড়াতে গিয়েছি আবার দিনের বেলাতেও গিয়েছি। তবে রাতের সৌন্দর্যটা অন্যরকম।

ভাগ্যক্রমে আপনি যদি ‘ভিভিড সিডনি’ (বাৎসরিকভাবে বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে অপেরা হাউসে আলোকসজ্জা করা হয়, সাথে থাকে গানের মূর্ছনা)  এর সময় বেড়াতে যান তাহলে তো কথাই নেই। অনেকটা বাড়তি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

আমি এই বছরের জুনের প্রথমদিকে গিয়ে এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করি। আপনি আগে থেকেই অনলাইনে খুঁজে নিতে পারেন কখন ভিভিড এর আয়োজন করা হয়।

 

হারবার থেকে জাহাজে করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে বেড়াতে পারেন। সেক্ষেত্রে খুব সহজেই ভালোভাবে চারদিক থেকে অপেরা হাউস, হারবার ব্রিজ কিংবা আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। আর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ক্যামেরা নিয়ে যাবেন। কারণ, আপনি না চাইলেও বিমোহিত হয়ে ছবি তুলতে থাকবেন।

ছবি তোলা নিয়ে একটা মজার কাহিনী বলি। আমি  একা একা বেড়াচ্ছি। তাই নিজের সেলফি তোলা বাদ দিয়ে কাউকে খুঁজছিলাম যিনি আমার ছবি তুলে দিতে পারবে। তো আমার পাশেই দেখি এক ভদ্রলোক বিশাল ক্যামেরা দিয়ে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। তাই ভাবলাম উনাকে দিয়ে আমার ছবিটা তুললে হয়তো ভালোই হবে।

ছবি তোলার পর দেখি আমার শরীর অর্ধেক আছে আর অর্ধেক নাই। আমি তো হতাশ। পরে তার সাথে কথা বলার পর ভেবে দেখলাম উনি তো এমন দেশ থেকে এসেছেন যেখানে অল্প দামে অনেক বড় আকারের ক্যামেরা কিনতে পাওয়া যায়। তাই বড় ক্যামেরা আর ভাব দেখে আসলে আমার ধারণা করাটাই ভুল ছিল।

যাই হোক, উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলাম। তারপর স্থানীয় ছেলেদের দিয়ে ছবি তুললাম। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি ছবিটা বাঁধিয়ে রাখবে?” আমি মুচকি হেসে বললাম, “হ্যাঁ।” মনে মনে বললাম,ছোটবেলায় স্টুডিওতে সিডনি অপেরা হাউসকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে তোলা ছবিটা এখনও বাঁধানো আছে।

সিডনি হারবার ব্রিজ বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। ১৯২৩ সালে কাজ শুরু হয়ে ১৯৩২ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এই ব্রিজটি ১৩৪ মিটার উঁচু এবং ১ হাজার ১৪৮ মিটার লম্বা। এটি তৈরি করতে গিয়ে কিছু লোক প্রাণ হারায়। আপনি চাইলে ব্রিজের উপর থেকে সিডনির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

 

সিডনি যাবেন আর বন্ডি বিচ যাবেন না, সেটা কি করে হয়? শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে অপরূপ এই বিচ। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করেই যেতে পারেন। বড় বড় ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ না করার লোভ আপনি সামলাতে পারবেন না। আর এখানে এসে একটা সেলফি না তুললে কি হয় বলুন? 

সিডনির প্রত্যেকটা বিচেই আপনি পিকনিক করতে পারবেন, ইলেকট্রিক চুল্লিতে বারবিকিউ করতে পারবেন, বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবেন, টয়লেটের সুব্যবস্থা আছে। আপনি চাইলে কিছু মশলা আর মুরগি কিনে নিয়ে যেতে পারেন। নিজের মতো বারবিকিউ করে সমুদ্রের পাড়ে বসে খেতে পারেন। বাসার বাইরে যদি এত সুন্দর ব্যবস্থা থাকে তাহলে আনন্দের আর শেষ কোথায় বলুন! 

সিডনিতে খাবারেরও বৈচিত্রের শেষ নেই। কোন দেশের খাবার খেতে চান? চীনা, ভিয়েতনামিজ, ইতালিয়ান, জার্মানি, আরব দেশের খাবার নাকি বাংলাদেশের? সিডনি আসলে মনে হবে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এক জায়গায় এত দেশের খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ খুব কম শহরেই পাওয়া যায়।

 

পাহাড় দেখতে আমরা কে খুশি না হই? কিন্তু সেটা যদি নীল পাহাড় হয়, তাহলে  তো মজার শেষ নেই। সিডনিতে আসলে আপনি নীল পাহাড় দেখার সুযোগ পাবেন।

সিডনি থেকে গাড়ি করে এক থেকে দেড় ঘণ্টার ড্রাইভে নীল পাহাড়ে যাওয়া যায়। নীল পানির সমুদ্র, নীল পাহাড় আর নীল আকাশ যদি ভ্রমণের সঙ্গী হয়, তাহলে এর চেয়ে আনন্দদায়ক ভ্রমণ আর কি হতে পারে? তবে নীল কাপড়ের জামা-কাপড় পরে এসব জায়গা ঘুরে বেড়ালে কিন্তু দারুণ লাগবে!

 

অস্ট্রেলিয়ার লোকজন কফি সংস্কৃতিতে আবদ্ধ। মিটিং করবেন তো কফি, বেড়াতে গেলেন তো কফি, আড্ডা দেবেন তো কফি। কফি পাগল অস্ট্রেলিয়ানরা। তবে অনেক মজার মজার কফির স্বাদ নিতে ভুলবেন না।

আমার ভ্রমণ অল্প সময়ের জন্য ছিল। তাই অনেক কিছু দেখার সৌভাগ্য হয় নাই। কিন্তু অনেক অতৃপ্ত বাসনা আপনাকে সবসময়ই অনুপ্রাণিত করবে আবার ভ্রমণের জন্য। আমিও আশায় থাকলাম, আজ অথবা কাল, যাব আরেকবার। আপনিও আসতে পারেন। যদি দেখা হয়ে যায়, এক কাপ কফি খাওয়াব আপনাকে।

লেখক: পর্যটক ও গবেষক

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

ইমেইল : debashisemp@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!