জার্মানিতে ৪০ বছর: বিদায়ের করুণ সুর

কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিনগুলো খুব দ্রুতই কাটছিল। একসময় দেখি যে আমার প্রথম ছয় মাসের ভাষা কোর্স প্রায় শেষের পথে।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2018, 06:23 AM
Updated : 9 August 2018, 06:23 AM

আগেই বলেছিলাম, এটা ছিল একটি সাধারণ কোর্স। এই কোর্স করে দৈনন্দিন জীবনের ভাষার কাজ চালানো যায়, তবে উচ্চশিক্ষার জন্য এটা ছিল অপর্যাপ্ত। একদিন আমাদের শিক্ষক গাবি জানালেন, আমাদের মধ্যে থেকে কেউ যদি এই স্কুলেই উচ্চতর কোর্স করতে চাই, তাহলে স্কুলের অফিসে গিয়ে যোগাযোগ করতে।

প্রায় ১০ সপ্তাহের ‘সার্টিফিকেট কোর্স’ নামে এই কোর্সের জন্য দিতে হবে দুইশ’ মার্ক। তখন খুব হিসেব করে চলতাম বলে ওই সময়ের মধ্যে পত্রিকা বিক্রি, লিফলেট বিতরণ আর প্রেসের কাজ করে আমার সেই দুইশ’ মার্ক জমা ছিল। গাবির কথা শুনে সব দিক বিবেচনা করে ভাবলাম, এই কোর্স করা যায়।

একদিন দুইশ’ মার্ক নিয়ে সেই স্কুলের অফিসে গিয়ে ভর্তি হয়ে আসলাম। নতুন এই কোর্সটি ফ্রাঙ্কফুর্ট অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা স্কুলে করা যেত, তবে কোর্সের শেষে একটি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হতো। আর সেটা হতো কেন্দ্রীয়ভাবে, অনেকটা আমাদের দেশের বোর্ডের পরীক্ষার মতো।

প্রথম ছয় মাসের কোর্সের শেষের দিকে আমরা সহপাঠীদের সাথে তখন ভাষার
প্রতিবন্ধকতা মোটামুটিভাবে উঠে যাওয়ার কারণে পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসলাম। এদের মধ্যে অনেকের সাথেই গল্প হতো যার যার দেশ, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে।

আগেই বলেছি যে এর মধ্যে নিয়মিতভাবে লেগে থাকতো কুর্দি ও তুর্কীদের সাথে উত্তপ্ত রাজনৈতিক আলোচনা। তবে ওদের এই আলোচনা ভালো লাগতো না যখন তারা উত্তেজিত হওয়ার পর তুরস্কের ভাষায় ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়তো।

বলতে হয়, বেশ তাড়াতাড়িই আমাদের এই ভাষা কোর্সের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এলো। তাই গাবি পরিকল্পনা করল, শেষ ক্লাসের দিন আমরা ব্রেকের পর ফেয়ারওয়েল পার্টির মতো কিছু একটা করবো। গাবি প্রস্তাব করল, ওইদিন যার যার পছন্দ মতো পানীয় বা হালকা খাবার নিয়ে আসতে।

গাবির কথা অনুযায়ী আমরা কেউ কেউ শ্যাম্পেন, বিয়ার, অরেঞ্জ ও আপেল জুস, বিস্কিট, বাদাম, চকোলেট ইত্যাদি নিয়ে গেলাম। সবাই যার যার মতো পান করলো বা খেল।

এ সময় আমি ভাবছিলাম, এই তো মাত্র ছয় মাস আগে আমরা ছিলাম অপরিচিত, ভাষা না জানার কারণে একে অপরের পাশে বসেও বোবার মতো থাকতাম। আর আজ এই উৎসবমুখর বিদায়ের ক্ষণে কে কতো কথা বলবে—তারই একটা যেন প্রতিযোগিতা চলছে। অবশ্য এটা বলতে হয় যে এই পরিবেশে শ্যাম্পেন আর বিয়ারের যথেষ্ট প্রভাব ছিল।

যত আনন্দের মধ্য দিয়ে বিচ্ছেদ বা বিদায়ের আয়োজন করা হোক না কেন, এর মধ্যে বিচ্ছেদের একটি করুণ সুর থেকেই যায়। জানি না সেদিন ক্লাসের অন্যরা কী ভাবছিল, আমি কিন্তু সত্যি ভাবছিলাম, এই ভাষা কোর্সের ছেলেমেয়েদের সাথে আজ বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। তাদের অনেকেরই সাথে আর কোন দিন হয়তো দেখা হবে না।

আসলেই কয়েকজন বাদে আর কারও সাথে আর কখনই দেখা হয়নি। তবে আমি কিন্তু অধিকাংশের নামই মনে রেখেছি। মানুষের জীবনই মনে হয় এরকম! বিশেষ করে প্রবাসে চলার পথে বা পড়াশোনা অথবা কর্মক্ষেত্রে কতো মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, আবার তারা যে কোথায় হারিয়ে গেছে- সেটা স্মৃতির পাতায় জমে থাকে।

চলবে…

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!