মনোমুগ্ধকর নায়াগ্রা জলপ্রপাতে

আমেরিকা-কানাডার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘নায়াগ্রা জলপ্রপাত’। এই দুই দেশের সীমান্তবর্তী এই জলপ্রপাতে প্রতি বছর যে পরিমাণ পর্যটক আসে, তার সংখ্যা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।

গৌরব দাশ নয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2018, 05:45 AM
Updated : 1 August 2018, 05:46 AM

তিন জল প্রপাতের সমন্বয়ে গঠিত এই নায়াগ্রা জলপ্রপাতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি পর্যটবান্ধব পার্ক ও অবলোকন ব্যবস্থা জগৎবিখ্যাত। অনেকে জাহাজযোগে জলপ্রপাতের নিচে গিয়ে একে বর্ণনা করে ‘স্বর্গের দ্বার’ বলে।

নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অবস্থান নিউ ইয়র্কের বাফেলো শহর আর কানাডার অন্টারিও প্রদেশের টরেন্টোর মাঝামাঝি। এক পাড় থেকে সহজেই দেখা যায় আরেক পাড়। একটি সেতু পার হয়েই যাওয়া যায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে।

নিউ ইয়র্কের শেষ প্রান্তে অবস্থিত বাফেলোয় যেতে পথে পড়ল নিউ ইয়র্ক স্টেটের রাজধানী আলবেনি। প্রাচীন স্থাপনায় ভরা এই শহরের মিল খুঁজে পাওয়া যায় ইউরোপের প্রাচীন শহরগুলোর সাথে। অবশ্য এখানে শহরের স্থাপনা ষোলো শতকে ইউরোপীয়রাই করেছে। এখানকার স্থাপনাগুলোর মধ্যে ‘নিউ ইয়র্ক স্টেট ক্যাপিটল’ বিল্ডিং উল্লেখযোগ্য।

আলবেনি থেকে বাফেলোর দিকে এগোতেই রাস্তার দুই পাশে অন্যরকম কিছু চোখে পড়ল, যেটা আমেরিকায় আমার দেখা পাঁচ-ছয়টি স্টেটে দৃষ্টিগোচর হয়নি। সেটা আমাকে বাংলাদেশের স্মৃতিও মনে করিয়ে দিল খানিকটা।

ধান গমের ক্ষেত। দুই দিকে বিশাল বিশাল খেত আর খামার বাড়ি দেখে আমি বলে উঠলাম, ফার্ম! তখন আমার ছোট্ট ভাগ্নে আমাকে শুধরে দিল, ফার্ম নয় সেটা বার্ন। এ যুগের বাচ্চারা সব জানে!

শহরের চেহারা দেখেই বোঝা যায় এটা অন্যতম পর্যটন শহর। দোকান-পাট থেকে শুরু করে হোটেল এয়ার বি এন বি’র বাহুল্য সে কথার জানান দেয়। নয় ঘণ্টার ভ্রমণক্লান্তি আর পরের দিন নায়গ্রা ফলস দেখার কৌতুহল নিয়ে আমরা ঘুমাতে গেলাম।

পরের দিন সকালে আমরা রওনা হলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের দিকে। প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ। পথের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে খবর পেলাম, আমার এক ভাগ্নি হয়েছে। এর আগের দিনের দুশ্চিন্তা দূর হল। দ্বিগুণ খুশিতে নায়াগ্রা ফলসের দিকে এগুলাম আমরা।

নায়াগ্রা ফলস পার্কে ঢুকতে প্রথমেই নায়াগ্রা নদীর অন্য পাশের কানাডার টরেন্টো শহর চোখে পড়ল। তার মধ্যে কানাডার প্রতীক ‘সি এন টাওয়ার’ অন্যতম। জলপ্রপাতের দিকে এগোতেই সবুজ পানি আর শো শো শব্দ কানে এলো। রোমাঞ্চ নিয়ে এগোতে থাকলাম আমরা পর্যটকদের মধ্যে।

অবশেষে দৃশ্যমান হলো অপূর্ব সুন্দর নায়াগ্রা জলপ্রপাত। সেই ১০ হাজার বছর আগে এর সৃষ্টির পর থেকে প্রথম নরডিক জাতি থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত, যারাই এই জলপ্রপাত দেখেছে তারাই বিস্মিত হয়েছে। কখনও কেউ সে অনুভূতি সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পেরেছে বলে আমার মনে হয় না।

খুব কাছ থেকে তিন জলপ্রপাতের সর্ববৃহৎ ‘হর্সশু ফলস’ দেখার পর নায়াগ্রা নদীর উপর নির্মিত অবজারবেটরি হয়ে আমরা উঠলাম ‘মেইড অফ মিস্ট’ নামক জাহাজে, যেটা যাত্রীদের নিয়ে যাবে জলপ্রপাতের একদম নিচে। এই জাহাজের অভিজ্ঞতাকেই বলা চলে সবচেয়ে স্মরণীয় ও রোমাঞ্চকর স্মৃতি।

আমেরিকা ও কানাডার দুই কূল ঘেঁষে উত্তাল ঢেউয়ে জাহাজটি ঘুরিয়ে আনে বাষ্প ওড়া জলপ্রপাতগুলোর খুব কাছে থেকে। সে অনুভূতি লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, ক্যামেরা বন্দি করাও দুঃসাধ্য। তবে সেখানে গিয়ে সৌন্দর্যকে শুধু স্বর্গের দ্বারের সাথেই তুলনা করা যায় (সিনেমায় সাধারণত অন্য জগতে প্রবেশ জলপ্রপাতের মাধ্যমেই দেখানো হয়)।

তবে বিরূপ আবহাওয়া বা ভয়ঙ্কর ঢেউয়ে যাত্রীরা সত্যি সত্যিই পৌঁছে যেতে পারে স্বর্গ বা নরকে! এজন্য যারা সাঁতার জানে না, তাদের অবশ্যই একবার ভাবা উচিত। অবশ্য মানুষ যেভাবে উপভোগ করছিলো, তাতে কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলো বলে মনে হয় না।

‘কেইভ অফ উইন্ড’ নামক এক গুহাও রয়েছে এখানে। জলপ্রপাতের উপর থেকে প্রায় ২৫ তলা নিচে সুরঙ্গের মতো পথে যাওয়া যায় এই গুহায়। গুহার মুখ খুলেছে ‘ব্রাইডাল ভেইল’ নামক জলপ্রপাতের নিচে। সেখানকার অভিজ্ঞতা অবশ্য আমি নিতে পারিনি অসুস্থতার কারণে। আমার সহাভিযাত্রী দিদি, জামাইবাবু আর ভাগ্নে নিয়েছেন।

নায়াগ্রা ফলসের আকর্ষণ শুধু প্রাকৃতিক জলপ্রপাতেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে রয়েছে গোট আইল্যান্ড, অবজারবেটরি, একুরিয়াম, মিউজিয়ামসহ আরও অনেক কিছু। পুরো এলাকা ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ এজেন্সির বাস।

সব মিলিয়ে ভ্রমণপিপাসুদের স্বর্গই বলা চলে এই নায়াগ্রা ফলস’কে। শুধু নায়াগ্রা ফলসই যথেষ্ট একটি দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্য নির্ধারণের জন্য। শুধু লেখায় আর ছবিতে এর মোহনীয়তা বর্ণনা করা অসম্ভব।

ডিসকভারিতে দেখানো ডকুমেন্টারিতে দেখা যায়, উনিশ শতকের গোঁড়া থেকে অনেকেই চেষ্টা করেছেন দড়ি বেঁয়ে বা অন্যভাবে এই জলপ্রপাত পার হওয়ার। ১৮৫৯ সালে প্রথম সফল হয় এক ব্যাক্তি। এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা তার বিড়াল নিয়ে কাঠের ব্যারেলে করে সফলভাবে জলপ্রপাতের উপর থেকে ভেসে এসেছিলেন পাড়ে। 

এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত দুই দেশের জন্য শুধু পর্যটকের মাধ্যমে অর্থ আনছে না, যোগাচ্ছে হাইড্রো-পাওয়ারও। বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানের ভূমিক্ষয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে ৫০ হাজার বছরে বিলুপ্ত হবে নায়াগ্রা ফলস। তাই এখন দেখতে না পারলে ঘাবড়াবেন না, হাতে অনেক সময় আছে!

লেখক: গণস্বাস্থ্য গবেষক ও কৃষিবিদ, এমপিএইচ, সেইন্ট জন’স ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!