সিঙ্গাপুরের আইন-কানুন ও প্রবাসীদের দায়িত্ব

আইনবিরোধী কিছু করা বা প্রচলিত আইন অমান্য করাই অপরাধ। প্রচলিত আইন অমান্য করলে শাস্তি পেতে হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বিভিন্ন দেশে অপরাধের ধরন বিভিন্ন রকম।

এম ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 July 2018, 05:16 AM
Updated : 21 July 2018, 05:16 AM

সিঙ্গাপুরে যেটা অপরাধ, ঠিক সেই কাজটা আমাদের দেশে স্বাভাবিক। আমাদের দেশে প্রকাশ্যে যেখানে সেখানে থুথু ফেললে কোনরকম শাস্তির সম্মুখীন হতে হয় না। বাংলাদেশে যদি হঠাৎ প্রকাশ্যে থুথু ফেলাকে নিষিদ্ধ করে আইন প্রনয়ণ করা হয়, তাহলে আমাদের তা মেনে নিতে সময় লাগবে। কারণ, বহুদিন যাবত প্রচলিত অভ্যাস আমরা সহজে ত্যাগ করতে পারব না।

সিঙ্গাপুরে প্রকাশ্যে যেখানে সেখানে থুথু ফেলা অপরাধমূলক কাজ। কেউ প্রকাশ্যে থুথু ফেললে তাকে প্রচলিত আইন অনুসারে সাথে সাথেই জরিমানা করা হয়।

এমন অনেক ধরনের কাজ আছে যা আমাদের দেশে সহজ স্বাভাবিক, কিন্তু সিঙ্গাপুরে তা অপরাধ। যেমন-আমাদের দেশে প্রকাশ্যে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে প্রসাব করা, প্রকাশ্যে থুথু ফেলা, চুইংগাম খাওয়া, প্রকাশ্যে খাবার খেয়ে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সিঙ্গাপুরে প্রকাশ্যে এই কাজগুলো করলেই বড় অংকের জরিমানা গুণতে হয়।

আর এই সমস্ত ছোটখাটো অপরাধে সিঙ্গাপুরে আসা অভিবাসীরা জড়িয়ে পড়েন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজ্ঞতাবশত কারণে যে এসব করে তা নয়, এই অপরাধগুলোর সাথে তারা জড়িয়ে পড়েন বহুদিনের অভ্যাসবশত কারণে। আর এই অভ্যাসবশত অপরাধের জন্য সিঙ্গাপুরে আগত সকল দেশের অভিবাসীদের দেখা গেছে জরিমানা দিতে, এমনকি এদেশের স্থায়ী বাসিন্দারাও এ থেকে রেহাই পায় না।

আমাদের দেশে অপরাধ বলতে বুঝি খুন করা ,ধর্ষণ করা ,চুরি করা, মাদক ব্যবসা অথবা অপহরণ করা ইত্যাদি। কেউ যদি বলে, সিঙ্গাপুরে অপরাধের সাথে বাংলাদেশিরা জড়িত, আর এই অপরাধের কথা শোনামাত্রই অপরাধের একটা কাল্পনিক চিত্র মনে মনে অঙ্কিত করি। বাস্তবে এমন ভয়ঙ্কর অপরাধের সাথে বাংলাদেশিরা জড়িত নাই বললেই চলে। আর এমনিই সিঙ্গাপুরে অপরাধ প্রবণতার হার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম।

তবে ছোটখাটো কিছু অপরাধমূলক কাজের সাথে আমাদের দেশি ভাইরা জড়িয়ে পড়ে। শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, সব দেশের অভিবাসী কর্মীরাই এই সমস্ত অপরাধকর্মের সাথে জড়িয়ে পড়ে। সিঙ্গাপুরে প্রবাসীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া নিয়ে কোন জরিপ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরের এক স্থানীয় পত্রিকায় জরিপে দেখলাম, সিঙ্গাপুরীয়ানরা অভিবাসী কর্মীদের চেয়ে বেশি অপরাধ কর্মের সাথে জড়িত।

তবে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কর্মীদের সুখ্যাতি অনেক যা অন্য দেশের কর্মীদের নেই বললেই চলে। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিদের বলা হয় ভদ্র, কর্মঠ, ধার্মিক, পরোপকারী, সাহিত্য অনুরাগী ও দানবীর। তাই সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীরা সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এতে তারা লাল-সবুজের পতাকাকে বিশ্ব দরকারে সম্মানিত করছে।

সিঙ্গাপুরে অভিবাসী কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত অপরাধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপরাধ হল প্রতারণা করা। প্রতারণা হলো কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার না হয়েও আদালতে গিয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা।

সিঙ্গাপুরে আইনে আছে, কোন শ্রমিক যদি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার হয়, তাহলে কোম্পানি তার চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে। দুর্ঘটনা যদি মারাত্মক হয়, তাহলে শ্রমিকরা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা পাবে। তাই অতি লোভের পড়ে কিছু শ্রমিক বাইরে আঘাতপ্রাপ্ত কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আদালতের স্মরণাপন্ন হয়।

প্রথম দিকে অনেকেই মিথ্যা মামলা করে আদালতের রায়ে বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে দেশে ফিরে যায়। কিন্তু দিনের পর দিন এ ধরনের মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আদালত নির্দেশ দেয়, যে কোন অভিযোগ যথাযথ তদন্ত করে সত্য-মিথ্যা যাচাই করা হবে। যদি শ্রমিকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে বড় রকম শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়।

সিঙ্গাপুরে সিগারেটের দাম আকাশচুম্বী এবং এদেশে প্রতিটা সিগারেটের গায়ে সিল মারা থাকে। সরকার কর্তৃক অনুমতিবিহীন বেআইনী সিগারেট খাওয়াও এখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সিঙ্গাপুরে যত্রতত্র ধূমপানও করা যায় না। ধূমপানের জন্য কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় সাইন ঝুলিয়ে মার্ক করে দেওয়া হয়েছে, এর বাইরে ধূমপান করা অপরাধ।

সিঙ্গাপুরে দেখা যায় অনেকেই সরকার কর্তৃক অনুমতিবিহীন বেআইনী সিগারেট খেয়ে জরিমানা দিয়েছেন। সিঙ্গাপুরে সরকারের অনুমতিবিহীন সিগারেট, পান, হ্যান্স খাওয়া ও এর বেচাকেনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অনেকেই এই ব্যবসার সাথে জড়িত হয়ে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।

সিঙ্গাপুরে পারমিটে উল্লেখিত কোম্পানি ব্যতিত অন্য কোন কোম্পানিতে কাজ করাও এই দেশে প্রচলিত আইন অনুসারে গুরুতর অপরাধ। যদি কেউ পারমিটে উল্লেখিত কোম্পানি ব্যতিত অন্য কোম্পানিতে কাজ করে, তাহলে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তির সম্মুখীন করা হয়।

হুন্ডি ব্যবসা কী? আমরা সবাই তা জানি, তবুও বোঝার সুবিধার্থে কিঞ্চিৎ আলোচনা করি। হুন্ডি হচ্ছে অবৈধভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ চালান দেওয়া। এই মাধ্যমটি জনপ্রিয় হচ্ছে কারণ এতে খরচ লাগে না, ব্যাংকের চেয়ে বেশি রেট পাওয়া যায় এবং দ্রুত গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যায়।

আমাদের দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী এটি অপরাধ। শুধু বাংলাদেশেই নয়, অনেক দেশেই এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। দেশের নাগরিকদের উচিত, দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলা। দেশের আর্থিক কল্যাণ সাধনের জন্য হুন্ডি ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

অনেক জিনিস আছে যেটা সমাজের জন্য যখন অমঙ্গল হয়, তখন সমাজের সকলে মিলে বা প্রশাসন যদি সেটাকে নিষিদ্ধ করে, সেটা আমাদের সবার মেনে চলা উচিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বলব, যেহেতু হুন্ডি ব্যবসা অথবা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর নিষেধ করা হয়েছে, তাই আমাদের বৈধ উপায়ে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ব্যাংকের মাধ্যেমে দেশে টাকা পাঠানো উচিত।

আমার পরিচিত এক ব্যক্তি সেদিন এসে জানাল, এক লোক তার চার লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়েছে। আমি যেন ওই লোকের ছবি ও মোবাইল নম্বরসহ ফেইসবুকে পোস্ট দেই। আমি তাকে অনেক বকাঝকা করে বললাম, “এই যুগে কেউ কাউকে লিখিত ডকুমেন্ট ছাড়া চার লক্ষ টাকা ধার দেয়?”

সে উপায়হীন হয়ে সত্য কথা বলল। আসলে তারা চার বন্ধু মিলে এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর নিকট চার লক্ষ টাকা দিয়েছেন তাদের পরিবারের নিকট পৌঁছে দেবার জন্য। কিন্তু ওই হুন্ডি ব্যবসায়ী তাদের কারো টাকা দেয়নি। বরং তাদের টাকাসহ অন্যদের মোট ৪৫ লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়েছে।

আমি সব শুনে বললাম, “বেশি লাভের আশায় অবৈধভাবে টাকা পাঠিয়েছেন, এখন উচিত শিক্ষা হলো আপনার।” সে কানে ধরে ওয়াদা করল আর জীবনে কোন আইনবিরোধী অবৈধ কাজ করবে না।

আরও একটি অপরাধ সিঙ্গাপুর বিমানবন্দর গেলে দেখা যায়,একদল লোক যাত্রীদের পিছন পিছন ঘুরছেন তাদের মাধ্যমে স্বর্ণ ও মোবাইল দেশে পাঠানোর জন্য। যার বিনিময়ে তারা বহনকারীকে একশ ডলার দিয়ে থাকেন। অনেক সচেতন প্রবাসী জানেন, এটা অবৈধ, অন্যায়। সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণ চালান করা হচ্ছে। কিন্তু কিছু অসেচতন প্রবাসী যাদের এ অপরাধ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেই, তারা একশ ডলারের লোভ সামলাতে পারেন না। আনন্দিত হয়ে একশ ডলারের বিনিময় একশ গ্রাম স্বর্ণ ও পাঁচটি মোবাইল নিয়ে যান।

এই ধরনের ছোটখাটো অপরাধের সাথে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত সব দেশের কিছু সংখ্যক অভিবাসী জড়িত। তাই আমি বলতে পারছি না যে সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত কতো শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশি এই সমস্ত অপরাধগুলোর সাথে জড়িত।

এই অপরাধগুলো দমন করতে হলে দরকার যথেষ্ট জনসচেতনা। একমাত্র জনসচেতনাই পারে প্রবাসীদের অপরাধ কর্ম থেকে দূরে রাখতে। আমার এই লেখা কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নয়। আমার এই লেখার উদ্দ্যেশ্য প্রবাসীদের মাঝে কিছুটা জনসচেনতা সৃষ্টি করা ও তাদের অপরাধগুলো সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়া।

লেখক : প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!