ডাইনোসরের বাড়ি

চীনের সিচুয়ান প্রদেশের ছোট শহর ‘জিগং’। ছোট ছোট পাহাড় সবুজ বনানীর এ শহরে গেলো শতাব্দীতে সন্ধান পাওয়া যায় জুরাসিক যুগের বিশেষ ধরনের পাথর ‘দাশানপু’।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2018, 09:17 AM
Updated : 11 July 2018, 09:51 AM

আশির দশকে এ ‘দাশানপু’ খুঁড়ে যা পাওয়া গেলো তা দুনিয়ার তাবৎ প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে সাড়া ফেলে দিল। শত শত ডাইনোসরের ফসিল, যারা হারিয়ে গিয়েছিল ১৫০ মিলিয়ন বছর আগে। ডাইনোরের এ প্রাকৃতিক সমাধিক্ষেত্রের উপরেই গড়ে উঠেছে ‘জিগং ডাইনোসর মিউজিয়াম’।

বেশ অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল ঘুরে আসার, কিন্তু সময় আর সুযোগ ঠিক হয়ে উঠছিল না। সম্প্রতি আমাদের এক পুরনো ছাত্রীর আমন্ত্রনে সুযোগ এসে গেলো জিগং ঘুরে আসার। আমার সদ্য-কৈশোরে পা দেয়া পুত্রের ভাষায় ‘ডাইনোসরের বাড়ি’।

বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে ‘জিগং জিওপার্ক’। তার প্রাণকেন্দ্রে এ মিউজিয়াম। ‘জিগং ডাইনোসর মিউজিয়াম’ পৃথিবীর বৃহত্তম ‘অন-সাইট ডাইনোসর মিউজিয়াম’। এতো অল্প জায়গায় এতো বেশি ডাইনোসরের ফসিল পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায়নি। এখানে সন্ধান পাওয়া গেছে প্রায় দুইশ ডাইনোসরের দশ হাজার ফসিল, সেই সঙ্গে আরো কিছু প্যালেওনটোলোজিক্যাল প্রাণীর ফসিল।

ডাইনোসরগুলোর তেইশটি জেনেরা এবং ঊনত্রিশটি স্পেসিস সনাক্তকরণ হয়েছে ইতিমধ্যে। কিছু ফসিল জোড়া লাগিয়ে পূর্ণাঙ্গ ডাইনোসরের রূপে সাজানো হয়েছে, আবার কিছু ফসিল আকারেই সংরক্ষণ করে রেখে দেওয়া হয়েছে আগামীর জন্য।

কিন্তু কথা হলো দুনিয়ার এতো জায়গা থাকতে এ এলাকায় এতোগুলো ডাইনোসর মরতে এলো কেনো, আর কেনোইবা এরা এখানে ফসিল হয়ে গেলো। এখন তো আর সম্পূর্ণ সঠিকভাবে জানার উপায় নেই। ডাইনোসরেরা ডায়েরি লিখেও যায়নি আর তাদের যুগে ফেইসবুকও ছিলনা যে সেগুলো পড়ে আমরা কিছু ধারনা পেতে পারি। তবে আর্কিওলজিস্ট এবং জিওলজিস্টরা কিন্ত দারুণ এক যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন।

জিগংকে বলা হয় ‘সল্ট-সিটি’। এ লবনের শহর প্রাচীনকাল থেকেই বিখ্যাত, মাটি খুঁড়ে লবন উৎপাদনের জন্য। অন্তত দুই হাজার বছর আগে এখানে লবন উৎপাদনের প্রমান পাওয়া যায়। ধারনা করা হয় শত মিলিয়ন বছর আগে এখানে সমুদ্র ছিল কিংবা সমুদ্রের যোগসূত্র ছিল এবং প্রচুর পরিমানে সল্ট-ব্রাইন ছিল। পরবর্তীতে ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারনে সমুদ্রের গতিপথও পরিবর্তিত হয় এবং বিশাল আকারের সল্ট-ব্রাইন মাটির নিচে ঢাকা পড়ে যায়।

সম্ভবত জুরাসিক যুগে বন্যা বা এরকম কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ডাইনোসরের বিশাল এক কাফেলা এ এলাকায় সৃষ্ট সামুদ্রিক ঘূর্ণিতে তলিয়ে যায়, এবং কালের বিবর্তনে সেখান থেকে সমুদ্র সরে গিয়ে স্থলভাগ জেগে ওঠে। মৃত ডাইনোসরগুলো ফসিল হিসেবে টিকে যায় শত মিলিয়ন বছর।

সল্ট-সিটিতে এসে এখানকার লবনের ইতিহাস না জেনে গেলে কেমন হয়? গেলাম ‘সল্ট মিউজিয়াম’-এ। মাটিতে গভীর কুয়ো তৈরি করে কীভাবে সেই প্রাচীনকাল থেকে এখানে লবন তৈরি করা হতো, সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসের নিদর্শন সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা আছে এখানে। প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় এ নিদর্শন বারবার জানান দেয়, প্রযুক্তিতে চীন সেই প্রাচীনকাল থেকেই কতো সমৃদ্ধ! জিগং শহরেই আছে ‘শেনহাই ওয়েল’। লবন উৎপাদনের জন্য ১৮৩৫ সালে খনন করা হয়েছিল এ কূপ। দুনিয়ার প্রথম কুয়ো যেটা কিনা এক হাজার মিটার গভীরে গিয়েছিল।

লবনকে কেন্দ্র করে এ শহরে গড়ে উঠেছে বিশাল ‘সল্ট পার্ক’। আর সেই সঙ্গে ‘ডাইনোসর পার্ক’ তো আছেই। সব মিলিয়ে ‘জিগং জিওপার্ক’ শুধু প্রত্নতাত্বিক আর ভূতাত্ত্বিকদের জন্যই নয়, সব ভ্রমণপিপাসু আর ইতিহাস-ঐতিহ্যপ্রেমী মানুষদের কাছেই এক বিশেষ আকর্ষণ।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইলঃ  asadkhanbmj@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!