চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার জন্য পরিচিত মাউন্ট ওয়াশিংটন নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত একটি অন্যতম টুরিস্ট স্পট। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বোস্টনের বেলমন্ট এলাকা থেকে আমরা মাউন্ট ওয়াশিংটনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আমার ভগ্নিপতি আইবিএমের সাইন্টিস্ট। তবে কম্পিউটারের জগতের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রমণের প্রতি তার অমোঘ আকর্ষণ। তার আগ্রহেই প্রায় পাঁচ ঘণ্টার এই গাড়ি যাত্রায় তার সহযাত্রী আমার দিদি, গ্রেড ওয়ান পড়ুয়া ভাগ্নে আর আমি।
মাউন্ট ওয়াশিংটনের বিশেষত্ব হিসেবে আমাদের মধ্যে আলোচিত হচ্ছিল মেঘ ছোঁয়া পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য, নিজেরা মেঘ ছুঁতে পারার সম্ভাবনা আর গাড়ি বা ট্রেনযোগে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার সুযোগ। প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচুতে বিনা কষ্টে আরোহনের সুযোগ রোমাঞ্চিত করল বটে, কিন্তু পাহাড়ি রাস্তার জন্য কিছুটা ভয় করছিলোনা বললে ভুল হবে।
রাস্তায় একবার বিরতির পর আমরা এসে পৌঁছলাম মাউন্ট ওয়াশিংটনের পাদদেশে এক রেস্ট এরিয়ায়। পর্বত আরোহনের প্রস্তুতি হিসেবে ফ্রেশ হওয়া আর দূর থেকে মনোরম মেঘ আর আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের ছবি তোলার ফাঁকে লক্ষ্য করলাম কিছু লোক গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটেই পর্বতে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার মনে হল এরা শৌখিন পর্বতারোহী। জীবনের সব স্বাদ নেয়ার চেষ্টায় আমেরিকানদের জবাব নেই।
আমাদের গাড়ি পাহাড়ের গেটে পৌঁছালে সেখানকার রক্ষণকর্মীরা আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমার ভগ্নিপতি প্রয়োজনীয় ফি দেয়ার পর তাকে পাহাড়ে গাড়ি চালানোর নির্দেশিকাসহ একটি স্টিকার দিলেন তারা যাতে লেখা রয়েছে, ‘দিজ কার হুয়াজ ক্লাইম্বড মাউন্ট ওয়াশিংটন’। এটি পেয়ে খুব খুশি হলো সবাই।
আমার দিদি সবচেয়ে চিন্তিত নাকি ভীত ছিলেন! আমরা সবাই-ই হয়ত ছিলাম। কিন্তু কেউই প্রকাশ করছিলাম না একে অন্যকে সাহস দিতে। আমার ভাগ্নে বারবার তার বাবাকে জিজ্ঞেস করছিলো এই পথ নিরাপদ কিনা। তার গাড়ি চালনার দক্ষতায় কারো প্রশ্ন নেই, কিন্তু এই খাঁড়া পাহাড়ে প্রথম চড়াইয়ে যে কোন চালক এবং যাত্রীদের বুকে ঈষৎ কাঁপন স্বাভাবিক। উপরন্তু তার আবেগের উদ্বেলিত বহিঃপ্রকাশ কী ভয়ের না রোমাঞ্চের সেটা আমরা বুঝতে পারছিলাম না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত উনি এই দুর্গমগিরি পার করে বা চড়ে সফল্ভাবে আমাদের চূড়ায় নিয়ে যান। পরে অবশ্য উনি বলেছিলেন যে এই দুর্গম খাঁড়া রাস্তায় গাড়ি চালাতে উনার ভয় করেনি এবং তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। পাহাড়ের এই দুর্গম পথ উঠার সময় চারদিকের মনোরম দৃশ্য অবশ্য আমি সবচেয়ে ভালো দেখলাম, গাড়িতে আমার অবস্থানের কারণে। পাশের বাড়িঘর আর হোটেলগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে যেতে থাকল। দূরে আকাশ আর মাটির মিশেলে যেন কয়েক স্তর যেন ভেসে উঠল, গাঢ় নীল, হালকা নীল আর সাদা।
আমরা দুই হাজার, চার হাজার ফুট দাগের পাথর পেরিয়ে মেঘের কাছাকাছি যেতে থাকলাম, যে হোটেলে আমরা বিশ্রামের জন্য থেমেছিলাম দূর থেকে তা পিঁপড়ের মতো মনে হলো। শেষ পর্যন্ত হোয়াইট মাউন্টেইনের চূড়ায় উঠলাম আমরা। ছয় হাজার ফুট উঁচুতে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য থাকাই স্বাভাবিক, কিন্তু সেখানে এর পাশাপাশি মানুষের তৈরি অনেক স্থাপত্যও রয়েছে।
পাহাড় চূড়ায় রয়েছে অবজারবেটরি, মিউজিয়াম, ট্রেন স্টেশন আর দেড়শ বছর পুরনো এক সরাইখানা যেটা এখন মিউজিয়ামের মতই ব্যবহৃত হচ্ছে। সবগুলোই মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা।
পর্যটকদের আনন্দ উৎসাহ এই কথাটিকে জোরালোভাবে সমর্থন দিচ্ছিল। ঘন কুয়াশার মতো কিছু একটা দেখা গেলো। বুঝতে পারলাম দূর থেকে আমরা যে মেঘ দেখি এটা সেই মেঘ-ই! মেঘের খুব কাছাকাছি এসে মেঘের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে যাওয়াটা বোধহয় ভালো হত না। আমাদের ভাগ্য ভালই বলতে হবে জোরে বৃষ্টি শুরু হলো। কিন্তু ভূপৃষ্ঠের সাধারণ মেঘের মতো সেটা লাগল না। একজন পর্যটক বললেন আমরা বর্ষণকারী মেঘের উপরে আছি। ভাবতেই একটু রোমাঞ্চ লাগল।
দিনের আলো নেভার আগে আমরা বাড়ির পথে রওনা দিলাম। মেঘ ছোঁয়া পাহাড়গুলো পেরিয়ে যেতে যেতে আমার ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করলাম, মেঘের স্বাদ তার কেমন লাগল। মুখ ভার করে সে জানালো জলের মতো। সে কোন স্বাদ ভেবেছিল কে জানে!
লেখক: গণস্বাস্থ্য গবেষক ও কৃষিবিদ, এমপিএইচ, সেইন্ট জন’স ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |