জার্মানিতে ৪০ বছর: সুইমিং পুলে হকারি

জার্মানিতে যেমন নতুন রাস্তাঘাট, ভাষা, পরিবেশের সাথে পরিচিত হচ্ছি, তেমনই মাসের সাথে আবহাওয়ার সম্পর্ক একটু একটু করে শিখছি।

শাহ আলম শান্তি, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 July 2018, 06:48 AM
Updated : 1 July 2018, 06:48 AM

শীতপ্রধান দেশ এই জার্মানি। তাই বছরের অধিকাংশ সময়ই ঠাণ্ডা থাকে। তবে এর মধ্যে জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারির ঠাণ্ডাটাই প্রায় নিয়মিত। মার্চে মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা কম হলেও কোন কোন দিন শীত ছেড়ে কথা কয় না।

আর এপ্রিল মাসকে আবহাওয়ার দিক থেকে বলা হয় হিসাব ছাড়া মাস। কারণ, এপ্রিল মাসের কোন দিনটা যে শীত থাকবে আর কোন দিন যে উষ্ণ হবে, সেটা ধারণা করা মুশকিল।

ইতোমধ্যে আমার জার্মানিতে প্রায় ছয় মাস কেটে গেল। বলতে হবে নতুন এবং সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে এসে ভালোই কাটল। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার পর সবচেয়ে যেটা কঠিন মনে হতো, সেই ভাষার ভয়টিও আর নেই। যতটুকু শিখেছি, সেটা দিয়ে বাইরে বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে যেতে পারি।

এই ভাষার ব্যাপারে যেটা আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিল যখন আমি কাউকে সহযোগিতা করার জন্য দোভাষী হিসেবে পুলিশ অফিসে যেতাম। তখন উনারা আমাকে প্রশংসা করতেন এবং উৎসাহ দিতেন।

এদিকে আমার ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পাওয়া প্রথম ছয় মাসের ছাত্র ভিসা প্রায় শেষের পথে। তাই আমি ওফেনবাখ শহরের বাসিন্দা হওয়ার কারণে একদিন গেলাম ওখানকার পুলিশ অফিসে। এখানে অফিসার আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না। আর করবেনই বা কেন, আমি যে ইতোমধ্যে দোভাষী হিসেবে পরিচিত।

তিনি দ্রুত আমাকে এক বছরের ভিসার সিল পাসপোর্টে লাগিয়ে দিলেন। তখন মনে পড়লো, প্রথম ছয় মাসের ভিসা আমাকে ফ্রাঙ্কফুর্টের ৩০৩ নম্বর কামরা থেকে পেতে কিনা ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল!

মে মাসে এখানকার গাছগুলোকে লক্ষ করে দেখলাম যে বেশিরভাগ গাছ যেগুলো শীতের মধ্যে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো, সেগুলোতে আবার পাতা গজাচ্ছে। এই গাছগুলোই বৃষ্টির সময় পর্যাপ্ত জল সঞ্চয় করে রাখে, যাতে শীতকালটা পাড়ি দেওয়া যায় । নতুনভাবে পাতা গজানো গাছগুলো দেখতে সত্যি অপূর্ব!

শীতকালটা পাড়ি দেওয়ার পর শীতের দেশের মানুষরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। ভাবেন, সামনের ক’টা মাস বেশ আরামেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আর আমরা যারা তখন পত্রিকা বিক্রি করতাম, তখন তো বেশি খুশি। কারণ, এখন আর ঠাণ্ডার মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। একটু খানি উষ্ণতার জন্য কোন দোকানে ঢুকতে হবে না।

পত্রিকা অফিসের ইয়ানের কাছে তখন লিফলেট বিতরণের কাজ বেশ ঘন ঘন আসতে থাকলো, সেই বিতরণের কাজ মাঝে মাঝে পেতাম। ভালো আবহাওয়া, মানে বৃষ্টি না হলে খারাপ লাগতো না, তবে প্রচুর হাঁটতে হতো আর সেই হাঁটাতে পরে পা ব্যাথা করতো।

ইয়ানের কাছে সেই যে বলেছিলাম যে প্রেসের কাজ আসতো, সেই প্রেসে মাঝে মাঝে রাতেও কাজ হতো। রাতের কাজটায় আমাদের মূলত ডাক পড়তো তখনই যখন দেখা যেত যে দিনে কোন মেশিন খারাপ হয়ে গেছে। সেই কাজগুলো পরেরদিন ভোরের মধ্যে শেষ করতে হবে।

দেখা যেত যে সন্ধ্যে থেকে শুরু হওয়া এই কাজ রাত ২টা বা ৩টা পর্যন্ত চলেছে, তখন অবশ্য আমাদের প্রেস থেকে ভাড়ার ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হতো। আর রাতের কাজের ঘণ্টার মার্ক দিনের থেকে কিছু বেশিই ছিল। যা পেতাম, সেটাতে আমরা সন্তুষ্টই ছিলাম।

১৯৭৮ সালের ওই সময় একসাথে সব কাজই করে যাচ্ছিলাম। ভাষা শেখা, পত্রিকা বিক্রি, মাঝে মাঝে লিফলেট বিলানো, প্রেসে কাজ করা। আর এছাড়া তো ঘরের কাজ আছেই। রান্না করা তেমনভাবে না শিখলেও যা করতাম সেটা খেতে পারতাম।

রান্নায় তখনও যেমন ছিলাম, পরবর্তীতে আমার ওই কাজে উন্নতি হয় নাই। তবে তখন থেকে অনেকে বলে যে আমি নাকি ভালো ডাল রান্না করতে পারি। ওই ডাল রান্না আমার দীর্ঘদিন একাকী থাকার সময় খুব সাহায্য করেছে।

দিন গড়িয়ে যেতে লাগলো, আবহাওয়া আরও সুন্দর হতে থাকলো। সেই সাথে শরীরের কাপড়ের বোঝাও কমতে থাকলো। হালকা কাপড় পরে তখন প্রথম বাইরে যেতে পারতাম।

উষ্ণতা বাড়ার সাথে সাথে এখানে পার্কগুলোতে, নদীর তীরে জনসমাগম হতে শুরু করে। আর একটু গরম পড়লেই এখানকার উম্মুক্ত সুইমিং পুলগুলোকে খুলে দেওয়া হয়।

আগেই বলেছি যে ইয়ান ব্যবসার সাথে সাথে আমাদের নিয়ে মজাও করতেন। একদিন সে পত্রিকা দেওয়ার সময় আমাকে বলল, “হের আলম, আমি আপনাকে আজ সুইমিং পুলে পাঠাতে চাচ্ছি।” তারপর মুচকি হেসে বলল যে ওখানে আপনি সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাবেন।

আমার তো ওই পর্যন্ত সুমিংপুল ছবিতে আর টেলিভিশনে দেখা ছাড়া বাস্তবে দেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। সেদিন আমাকে পাঠানো হয়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট হেডার্নহাইম সুমিংপুলে। আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট কেন্দ্রস্থল থেকে মিনিট ১৫ পরে ওখানে পৌঁছালাম।

পত্রিকার ট্রলি নিয়েই ভিতরে প্রবেশ করলাম। পত্রিকা বিক্রেতা হিসেবে আমাকে কোন প্রবেশমূল্য দিতে হলো না। ভেতরে গিয়ে দেখি শিশু থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত কেউ জলে সাঁতার কাটছে অথবা কেউ সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে এই মনোরম আবহাওয়া উপভোগ করছে।

সত্যি বলতে কি, তখন আমার পত্রিকার ট্রলি আর জ্যাকেট গায়ে ওই পরিবেশে হাঁটতে খুব বেমানান আর খারাপ লাগছিল। তাই সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আজ আমি পত্রিকা বিক্রির কোন চেষ্টাই করবো না। সাথে সাথে জ্যাকেট খুলে ট্রলিটা পাশে রেখে বেশ কিছুক্ষণ ঘাসের উপর বসে থাকলাম।

কিন্তু ইয়ানের সেই সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখা আমার হয়নি বা দেখতে চাইও নাই। কারণ তৃতীয় বিশ্বে জন্ম নেওয়া আর অনেকটা বেড়ে উঠলেও কোনদিন আমার চোখ বেহায়া হয়নি, আর ওই সুমিং পুলেও হয়নি।

হ্যা, ওটাই ছিল আমার সুমিং পুলে বিক্রির জন্য প্রথম আর শেষ যাওয়া।

চলবে…

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও পড়ুন-

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!