যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রতীক ‘লিবার্টি বেল’

‘সিটি অব ব্রাদারলি লাভ’ বা ‘ভাতৃত্ববোধের শহর’ ফিলাডেলফিয়া যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ‘প্রথম’ এর ধারক। এখানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম চিড়িয়াখানা, হাসপাতাল, মেডিক্যাল ও স্কুল।

গৌরব দাশ নয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2018, 12:13 PM
Updated : 24 June 2018, 12:14 PM

যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম জন্মদিন পালনকারী এ শহর থেকেই দেশটির প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। তবে কোনো প্রথমের খোঁজে নয়, এ শহরে আমাদের আগমন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীক ‘লিবার্টি বেল’ দেখার জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতীক ছয়টি। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, বল্ড ঈগল, স্ট্যাচু অব লিবার্টি, লিবার্টি বেল ও এক আধা কাল্পনিক চরিত্র ‘আঙ্কেল স্যাম’। হিসাব করে দেখলাম, জাতীয় পতাকা হরহামেশা দেখছি, জাতীয় সঙ্গীত শুনেছি, ঈগল দেখেছি চিড়িয়াখানায়, নিউ ইয়র্কে অনেকদিন থাকার সুবাদে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি ভ্রমণও শেষ হয়েছে, তাহলে দু’ঘণ্টা দূরের ‘লিবার্টি বেল’ বাদ যাবে কেন!

‘আঙ্কেল স্যাম’ ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকের এক কিংবদন্তি, বাস্তবিকভাবে এখন তার দেখা পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষ হয়ে থাকলেও নয়। তাই কার্টুন অথবা ছবিতে তার দর্শনই এ প্রতীকের অভিজ্ঞতা বলে ধরে নেয়া যায়। তাই জাতীয় প্রতীক দেখার ষোলকলা নাকি ষষ্ঠকলা পূরণ করতে রওনা দিলাম ফিলাডেলফিয়ার পথে, সঙ্গী মামা-মামী ও গ্রেড ওয়ান পড়ুয়া মামাত বোন।

নিউ ইয়র্ক থেকে পেনসিল্ভেনিয়ার রাজধানী ফিলাডেলফিয়ায় বাসে করে যেতে পথে মনোরম কিছু চোখে পড়ল না, এর চেয়ে নিউ হ্যাম্পশায়ার বা ম্যাসাচুসেটসের পথ অনেক দৃষ্টিনন্দন। বলার মতো একমাত্র নিউ জার্সির নিউ আর্ক লিবার্টি এয়ারপোর্টের অংশবিশেষ দেখা গেলো। বাস স্টেশনে নেমে আমরা পায়ে হেঁটেই রওনা দিলাম লিবার্টি বেল সেন্টারের দিকে।

মাত্র কয়েক ব্লক বলে উবার বা মেট্রোরেলের দিকে গেলাম না। এতে লাভ হলো বটে, চোখে পড়ল বিশাল এক ম্যুরাল, এত বড় ম্যুরাল আমার জীবনে দেখিনি। ফিলাডেলফিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যুরাল রাজধানী’ বলা হয়। নিউ ইয়র্ক বা অন্য রাজ্যের তুলনায় দশ মিনিট সরু পথ হেঁটে আমরা লিবার্টি বেল কমপ্লেক্সে পৌঁছলাম। ভালো আবহাওয়ার জন্য বোধহয় আজ অনেক ভিড়, ভিড়ের বেশির ভাগই স্কুলের শিশুদের দল যারা নিজেদের শিক্ষা সফরে এসেছে নিজেদের শ্রেণি শিক্ষকের সঙ্গে।

লিবার্টি কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বার সাদামাটা ও উন্মুক্ত। কমপ্লেক্সের পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ন্যাশনাল হিস্টোরিকাল পার্ক’ এর মূল ভবনসহ বিরাট মাঠ, বসার জায়গা এবং দৃষ্টিনন্দন ফুলের বাগান। বলতে গেলে, এ শহরের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো লিবার্টি বেল কমপ্লেক্স থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বেই।

কমপ্লেক্সে ঢুকতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হলো আমাদের। যদিও প্রবেশ বিনামূল্য কিন্তু সিকিউরিটি চেকের ক্ষেত্রে গার্ডরা কোনো কার্পণ্য দেখালো না। এসবের ধকল পেরিয়ে যতই এগোতে থাকলাম আমরা চোখে পড়ল লিবার্টি বেল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্মৃতি বিজরিত অনেক নিদর্শন। এ বেল দেখতে আসা বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ছবি ও উক্তিও শোভা পাচ্ছে, তাদের মধ্যে নেলসন মেন্ডেলার ছবিটি উল্লেখযোগ্য।

অবশেষে বিখ্যাত লিবার্টি বেলের দেখা পেলাম আমরা। কমপ্লেক্সে সুরক্ষিত এ বেলটি আর বাজানো হয়না প্রায় দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে, কিন্তু এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য আজ এ সম্মান। লিবার্টি বেলের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ ও মজাদার। ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনের খবর জানানোর জন্য বাজানো হয় এ বেল। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও আবেগের প্রতীক এ ঘণ্টা। এ বেলের ইতিহাস এ স্বল্প পরিসরে বলা হয়ত সম্ভব নয়, তবে কিছু বিচিত্র ও মজাদার ঘটনা না বললেই নয়।

১৭৫০ এর দশকে এ বেলটি যুক্তরাজ্য থেকে আনানো হয়। ৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই এ বেল বাজানোর যে কিংবদন্তি লোকমুখে প্রচলিত তার আসলে কোনো প্রমান নেই। ইতিহাসবিদদের তথ্য অনুযায়ী, এ বেল স্বাধীনতা লাভের খবর প্রচারের জন্য বাজানো হয় ৮ জুলাই ১৭৭৬ সালে।

আরেকটি মজার তথ্য, অনেক ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে এটি কারিগরি ত্রুটিরও অন্যতম নিদর্শন। কারন যুক্তরাজ্য থেকে আনার পর পরই তাতে ফাটল দেখা যায়, যা ক্রমাগত বড় হতে থাকে। পরবর্তীতে দুই স্থানীয় কামার এর মেরামত করেন, যাদের নাম বেলের গায়ে খোদাই করা আছে। দুর্ভাগ্যবশত সেটা আবার ফেটে যায়। এ ফাটলের জন্যই বেলটিকে পার্শ্ববর্তী লিবার্টি হলের ভবনের চূড়া থেকে নামিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় দুই শতাব্দী ধরে বিভিন্ন রাজ্যে প্রদর্শন করা এ বেল বিভিন্ন স্থান পরিবর্তন করে ২০০৩ সালে স্থায়ী হয় বর্তমান ঠিকানায়।
আগের দিন থেকেই আমার ছোট মামাতো বোন জিজ্ঞেস করছিলো বেলটি বাজিয়ে দেখা যাবে কিনা। অতিসংরক্ষিত এ বেলটি বাজানোর অনুমতি ও অবস্থা যদি থাকতও তার পক্ষে ৯০০ কেজি ওজনের এ বেল বাজানো হয়তো সম্ভব হত না। তার বাবা অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন বেলটি বাজাতে দেবেন, ভাগ্য ভালো সে আর বায়না ধরেনি।

অবশ্য সব দর্শনার্থী শিশুদের প্রশ্নই সেরকম। বেলের গার্ড কাম গাইডের ইতিহাস বর্ণনার পর শিশুদের প্রশ্নবানে তাকে জর্জরিত হতে হলো, তবে তিনি হাসিমুখেই সব উত্তর দিলেন। এক শিশু আবার বলে বসলো তার বাসায় এর চেয়ে বড় একটি বেল আছে! আরেকজন সেটার প্রতিবাদও করলো, সেই দ্বৈরথ অবশ্য বেশি এগলো না আমেরিকানদের সৌজন্যটার কারনে।

লিবার্টি বেল দেখার পর রিডিং টারমিনাল এবং এর ‘হগ স্ট্যাচু’ দেখে আমরা নিউ ইয়র্কগামী বাসে চড়ে বসলাম। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছয়টা। ইন্ডিপেন্ডেন্স হলের চূড়া থেকে ঘণ্টা বেজে উঠল, মনে হলো যেন সেই ১৭৭৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা উপলক্ষে ঘণ্টা বাজছে, সে অনুভূতি হয়তো রেডিওতে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার ঘোষণার মতই হবে। কারণ স্বাধীনতা যে দেশেরই হোক তার ঘণ্টাধ্বনি যে বড়ই মধুর।

লেখক: গণস্বাস্থ্য গবেষক, কৃষিবিদ, সেইন্ট জন’স ইউনিভার্সিটি, নিউ ইয়র্ক

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!