ইরানের ডায়েরি: মিলিয়নিয়ার হওয়ার স্বপ্নপূরণ

কত কী ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পরলাম আমি। তবে খুব একটা সুখের ঘুম হলো না, প্রচণ্ড গরমে ঘুম ভেঙে গেলো। তার উপর চোখ আর নাকের জ্বালাপোড়া।

মুহাম্মদ সাহেদুল আলম, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2018, 11:01 AM
Updated : 20 May 2018, 11:57 AM

উঠে হিটারটা বন্ধ করতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। সুইচ কাজ করে না, ডাইরেক্ট লাইন হয়ে আছে। পরে বুদ্ধি করে একটা অকাম করলাম। হিটার চলছে, সঙ্গে এয়ার কুলারটা ছেড়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলাম।

মোবাইলের অ্যালার্মে ঘুম ভাঙল। ফ্রেশ হয়ে বাকিদের ডেকে চলে গেলাম নাস্তা করতে। তখনও আকাশে রোদ উঠি উঠি ভাব। বারোতলার ছাদ থেকে দেখতে ভালই লাগছিল ঘুমন্ত শহরটাকে। যদিও সবুজের খুব অভাব, তারপরও কেমন যেন একটা মায়া চারপাশে। তেহরান শহরটা মোটামুটি পাহাড় ঘেরাই মনে হলো আমার কাছে, অন্তত আমরা পাহাড়ের উপরই ছিলাম।

তথাকথিত রিফুউজি রুটি

কী এক ধরনের শক্ত রুটি, জ্যাম দিয়ে সকালের নাস্তা সারতে হলো। দাঁত ব্যথা হবার জোগাড় ওই রুটি খেয়ে। আর জ্যামটাও এত চিনিতে ভরা! এদের কালচারে মিষ্টির খুব ব্যবহার মনে হলো আমার কাছে। কে একজন যেন বলেই ফেলল, এই রিফুউজি রুটি ছিল আমাদের কপালে!

পাশেই ভার্সিটির একটা কনফারেন্স হল। আমাদের জন্য এক অধ্যাপক ইরানের উপর একটা প্রেজেন্টেশন দিলেন। পানি সমস্যায় জর্জরিত ইরান আর তেলনির্ভর অর্থনীতি, এ নিয়ে পরের লেখাগুলোতে বলবো।

তবে আমার ছোট অনুধাবন হচ্ছে, পৃথিবীর মাথাওয়ালারা যত নাটক আর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে তার কারন দুটো- অস্ত্র ব্যবসা আর তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ কিংবা তেল দখল তথা বিনামূল্যে আদায়। ইরানকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তারা তেলের বাজারটা কমিয়ে রেখেছে। ইরানও বেঁচে থাকতে গিয়ে খুব কম দামে তেল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের কথা হচ্ছে, এই তেল ফুরিয়ে গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী করে বাঁচবে? আমাদের তো পানিও নেই!

অতীত এর উপর বসে দূরের বর্তমান দেখা

এরপর একটা কর্মশালা ছিল আমাদের জন্য, ‘ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর ওপর। যিনি পরিচালনা করলেন, তিনি আমাদের অসংখ্য উদাহরণ দিলেন কী করে কোনো কাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমানো যায়। তিনি একটা ব্রিজের উদাহরণ দিলেন, যেখানে মোট বাজেট থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার, প্রায় ৩৫% বাঁচল, বেঁচে গেছে এই ‘ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর কল্যাণে। শেষে তিনি বললেন, আমি নানা দেশে এ নিয়ে কাজ করতে চাই।

আমার বেলায় আমি বললাম, আমার দেশে আমি জীবনে শুনিনি বাজেট কমে। আমি ক্ষুদ্র জীবনে যতটা দেখেছি, জেনেছি, আমার দেশে প্রকল্পের ব্যয় সবসময়ই ধারনার চাইতে বাড়ে। সুতরাং, আমার এই ব্যাপারে আগ্রহ নেই।

যেই দেশে ২০ টাকার বাজেট ধরা হয় ১৫ টাকা ভাগবাটোয়ারা করার জন্য, আর ৫ টাকা মানুষকে দেখানোর জন্য, তাদের জন্য আর যাই হোক ‘ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিং’ প্রযোজ্য নয়। বরং ‘ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর জনকের লাশটাও এদেশে খুঁজে পাবার কথা না, সরাসরি গুম!

ঊষায় তেহরান

দুপুরে খাবার খেতে গিয়ে মাংস দেখে ভাবলাম, বাহ জমবে ভালো। কিন্তু মাংসেও মিষ্টির ছোঁয়া। বিকেলটা ছিল উন্মুক্ত। কেউ পাহাড়ে ঘুরতে গেলো, কেউ ঘুমালো। গাছ ছাড়া এই পাথুরে পাহাড় আমার ভালো লাগল না। একটু ঘুমিয়ে বাইরে হাঁটতে বের হলাম। বেশ দূরেই একটা মসজিদও পেলাম। এরা এত সুন্দর করে মসজিদ বানায়! প্রকৌশল আর নকশা মন ভোলানোর মতো।
পাহাড়ের কোল ঘেষে শিশুদের জন্য বানানো শিশুপার্ক আর বয়স্কদের জন্য আড্ডার জায়গাটাও একটু ঘুরে এলাম। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে কিছু ইউরো থেকে ইরানি রিয়ালে ভাঙালাম। আমি মোটামুটি তখন মিলিয়নিয়ার। কারন, এক ইউরোতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইরানি রিয়াল মিললো।

এরপর খেতে গেলাম এএসপি টাওয়ারে। এই জায়গাটা মোটামুটি বিখ্যাত বলা চলে। আর বর্তমান আধুনিক তরুণ সমাজও আড্ডায় মাতে এইখানে। তবে মাথায় কাপড় দেওয়া জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা ইরারি সুন্দরীদের সঙ্গে কথা বলার খুব একটা সাহস হয়নি। যদিও তারা এতগুলো বিদেশি দেখে একটু তাকিয়েই ছিল আমাদের দিকে।

পাহাড়ঘেরা তেহরান

আমরা ‘পাঞ্জ-ধারি’ নামে ইরানি ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টে খেলাম। আমি তো বাহার কাবাবের বাহারি সাজ দেখেই অবাক। তবে, এরা খুব তেলও খায় খাবারের সঙ্গে। আর অধিকাংশ খাবারে তারা আনার বা ডা‌লিম ব্যবহার করে।

দিনে গরম লাগলেও রাতে হঠাৎ করে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। শীতে আমার জমে যাওয়ার দশা। তখন আমাদের সাথের একজন শিক্ষক ভাগনর তার শরীরের একটা জ্যাকেট আমাকে খুলে দিয়ে বললেন, আমি সার্ভাইব করব। কিন্তু তোমারও সার্ভাইব করা দরকার! উনার আচরণে আমি অবাক হলাম কিছুটা, মানুষ হওয়াটা খুব দরকার সত্যি। মানুষ হওয়াটা এখনও অনেক দেরি আমার জন্য।

পাথুরে পাহাড়ে জমাট তুষার

ফেরার সময় ট্যাক্সি ড্রাইভারটা খুব উল্টাপাল্টা গাড়ি চালালো, জোরে গান ছেড়ে নাচতে নাচতে চলল সে। হুইলে যেন হাত দি‌তেই চায় না সে। আমার সঙ্গে ছিল আম্বিকা, স্টেফেন আর লিয়নি। বারবার সে লিয়নিকে নাচতে বলল! ভয়ে ভয়ে কোনমতে গেস্ট হাউজে ফিরলাম। গাড়ি থেকে নামার পর সে লিয়নিকে কী বলার জন্য ডাকল। আমি লিয়নিকে নিষেধ করলাম। বললাম, ফিরে চল। দরকার নেই।

আসলে, আমরা বিদেশিদের যতটা সহজসাধ্য ভাবি, ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি উল্টো। ছোট ছোট পোশাক পরে মানেই যে, উনাদের কোন আত্মসম্মান কিংবা মূল্যবোধ নেই , বিষয়টা কিন্তু তেমন নয়। তারা খুব সহজে আপনার আমার সঙ্গে মিশতে পারে, কারন তারা ধরে নেয় আপনি বা আমিও তাদের মতো করে ভাবতে জানি।

গাড়িতে উঠে প্রথম ড্রাইভা‌রের সঙ্গে আমরা একটু তাল মিলিয়েছিলাম, আর সে ধরে নিলো আমরা তার খুব বন্ধু হয়ে গেলাম!

(চলবে)

লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী, বন বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানি

ই-মেইল: agt.shahed@gmail.com

লেখকের আরও লেখা:

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!