মায়ের জন্য প্রবাসীর কান্না

কাজ থেকে ফিরে এসে রান্না শেষ করে খাবার সামনে নিয়ে বসেছি, এমন সময় মোবাইলে কল বেজে উঠল। আগে খাব, নাকি কল ধরব- এই নিয়ে দোটানায় পড়ে গেলাম।

এম ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2018, 04:49 AM
Updated : 16 May 2018, 04:49 AM

খাবার শেষ করে কল ধরার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু রুমমেট একজন চেঁচিয়ে বলল, “ভাই কল রিসিভ করেন, নয়তো রিংটোন বন্ধ করেন। আপনার মোবাইলের রিংটোনে আমাদের সমস্যা হচ্ছে।” বাধ্য হয়ে খাবারে হাত না দিয়ে কল ধরলাম।

সালাম দিলাম, কিন্তু ফোনের ওপাশ থেকে কোন কথার শব্দ এল না। শুধু কান্না শুনতে পেলাম।  আমার বুঝতে বাকি রইল না কি হয়েছে। উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলাম, “দুলাভাই, মা কয়টায় মারা গেছে?”

উনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, “বিকাল ৩টায়, আপনি ডিউটিতে ছিলেন, তাই বিকালে জানাইনি।”

আমি আর কথা বাড়াতে পারলাম না। লাইনটা কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার কান্না দেখে রুমমেট সবাই আমার পাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে কি হয়েছে জানতে চাইল। একজন কাঁধে চাপ দিয়ে জানতে চাইল, “কি হইছে ভাইয়া?”

আমি কোনো রকমে বললাম, “আমার মা মারা গিয়েছে।” কথাটা বলতে গিয়ে মনে হলো গলার ভেতর শক্ত কিছু দলা পাকিয়ে কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে। আমি কাঁদতে চাইছি না, কিন্তু হাউমাউ করে কান্না চলে আসছে। কান্নায় এতো তৃপ্তি, এই প্রথম টের পেলাম!

আমার কান্না দেখে উপস্থিত সবার চোখেও জল ছলছল করছে। মানুষ নাকি অনুকরণীয় প্রাণী। কাউকে কাঁদতে দেখলে সেও কাঁদে, হাসতে দেখলে সেও হাসে। আমার কেন কান্না আসছে বুঝতে পারছি না, আমি তো মায়ের মৃত্যু কামনা করেছিলাম।

মা দীর্ঘদিন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, পরপর পাঁচবার ব্রেইন স্ট্রোক করে কোমায় ছিলেন। তাঁর পুরো শরীর বিকল হয়ে গিয়েছিল, শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক ছিল। মায়ের স্ট্রোক হবার পর মাকে সুস্থ করার জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করি।

পর্যায়ক্রমে মোট পাঁচটি হাতপাতালে মায়ের চিকিৎসা চলে। সর্বশেষ চিকিৎসা করানো হয় ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ডাক্তার যখন বললেন, “মায়ের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই, এখন মিরাকলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই, তখন বাধ্য হয়ে কোমা অবস্থায় মাকে বাড়ি নিয়ে আসি।”

খাবার-দাবার, প্রাকৃতিক কাজগুলো চলছিল কৃত্রিম উপায়ে। তাই পরিবারের সবাই মায়ের সেবা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলাম। সবার চোখে মুখে এক ধরনের বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল। কেউ মুখে মুখেই বিরক্ত প্রকাশ করছে, কেউবা আচার ব্যবহারে, মুখের ভাবভঙ্গিতে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মা মরে যাক।

মা মরে গেলেই আমাদের মুক্তি, এই অবর্ণনীয় কষ্টের চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো মনে করেছিলাম। প্রতিদিন বিধাতাকে বলেছি, হয় মাকে সুস্থ করে দাও নয়তো এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে নিয়ে যাও।

মা অসুস্থ হবার পর আমাদের সাধ্যের মধ্যে সবটুকু দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছি। হাসপাতালে প্রতিদিন আমাদের আত্নীয়-স্বজনরা মাকে দেখার জন্য ভিড় করতো।

অধিক শোকে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা টের পাইনি। পরেরদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো অফিসে যাই। আমি সিঙ্গাপুরে এসেছি মাত্র চার মাস, তাই জানা ছিল না পিতামাতার মৃত্যুতে শোক পালনের জন্য কোম্পানি তিন দিনের ছুটি দেয়।

অফিসে গিয়ে সব আগের মতোই আছে। মায়ের মৃত্যুতে চারপাশে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সবাই হাসি মুখে একে অপরের সাথে গল্প করছে। কেউ জানতে চাইল না, গতকাল রাত থেকে আমার বুকের ভেতর ভয়ানক এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে ঝড়ে আমি লণ্ডভণ্ড!

সকালের ব্রিফিং-এর পর আমার কর্মক্ষেত্র জাহাজে গেলাম। জাহাজে গিয়ে কাজ করছি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি ইহজগৎ থেকে বহুদূরে। এই জগতের সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আশেপাশের মানুষগুলোকে আবছা আবছা ছায়া মনে হচ্ছে। আমি তাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছি। তাদের কথাগুলো প্রতিধ্বনি হয়ে আমার কাছে বাজছে।

নিজেকে স্থির করে কাজে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। কাঁধে একজনের নরম হাতের স্পর্শে আমার হুশ ফিরে এলো।

আমার অফিসার পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে আপনার? সেই কখন থেকে আপনাকে ডাকছি, কিন্তু আপনি শুনছেন না। আপনি অসুস্থ নাকি?” আমি মলিন বদনে মাথা নেড়ে বললাম, “না, কিছু না।”

অফিসারের বুঝতে বাকি রইল না। কারণ আমি সবসময় হাসিখুশি একজন মানুষ। আজ হঠাৎ আমার এই অবস্থা তাকে ভাবিয়ে তুলল, সে আন্তরিকভাবে জানতে চাইল কী হয়েছে। তার আন্তরিকতায় আমি নিজেকে শক্ত রাখতে পারলাম না।

বুকের ভেতর জমানো শোক আর কান্না যেন নতুন কোনো আশ্রয় খুঁজছিল। সে আশ্রয়কে কেন্দ্র করে আর থামিয়ে রাখা গেল না। আমি অফিসারকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। তখন নিজেকে শিশু মনে হয়েছিল। সমস্ত লজ্জা ভুলে আমি ক্রমাগত কান্না করে চলেছি। আমার কান্না দেখে আশেপাশের লোকজন কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

অফিসার জানতে চাইলো- কী হয়েছে? আমি মৃদু স্বরে বললাম, “ভাই, গতকাল আমার মা মারা গিয়েছেন।” তিনি কোনো কথা না বাড়িয়ে বললেন, “তোমাকে কাজ করতে হবে না, তুমি বিশ্রাম নাও।”

সেদিন আর কাজ করতে হয়নি। সারাটা দিন কেঁদে কাটিয়েছিলাম।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এ লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!