নিহন দিনের গল্প: প্রথম কিস্তি

বাড়ি ছেড়ে জাপানের পথে যাত্রা শুরু করি ২০১৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। সঙ্গে সর্বসাকুল্যে ৪৫ কেজি ওজনের তিনটা লাগেজ আর ট্রেনিং সেন্টার থেকে দেয়া এক তোড়া কাগজপত্র।

তাহসিনা আফরিন শারমিন, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2018, 01:48 PM
Updated : 23 April 2018, 01:48 PM

তখন বাড়ি ছাড়ার কষ্ট, একাকী যাত্রার বিষণ্ণতা আর দীর্ঘ পথের ক্লান্তির চেয়েও বেশি ঘিরে ধরেছিল গন্তব্যে ঠিকভাবে পৌঁছাবার চিন্তা। ভাগ্যিস, পতিদেব এই মরার চাকরিতে জয়েন করার অনেক আগেই আমাকে দেশ-বিদেশ বিস্তর ঘুরিয়েছিলেন!

সেই অভিজ্ঞতাই তো এ চাকরিতে মুফতে মিলিয়ে নিচ্ছি। না হয়, যে কয়েক অভাগা ‘বিদেশ মন্ত্রণালয়’-এ চাকরি করেও বিদেশযাত্রার সুযোগ কম পেয়েছে, এই নাচিস সেই ব্যাচেই অবস্থান করছে। সেটা পোষাতেই ‘অনন্তকাল’ এর জন্য তথাকথিত কিম্ভূত এই ভাষা শিক্ষার নিমিত্তে দীর্ঘ প্রবাস জীবন যাপনের ‘দুর্ভাগ্য’ মিলল কিনা কে জানে।

সে যাই হোক, এই প্রথম একাকী ভ্রমণে নার্ভাসনেস থাকাই স্বাভাবিক! তবে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে নিখুঁত থাকার ভাবনা আমাকে স্বস্তিতে খুব কমই রাখতে পেরেছে। এই যাত্রাও নির্ভুল করার তাড়না তাই কম ছিল না।

ওই এক তোড়া কাগজের কথায় আসি। এই কাগজে সেন্টারের নানা রকম নিয়মাবলীর সঙ্গে ছিল দুটো ম্যাপ, ইন্সটিটিউটের বাসের টাইম টেবিল ও একটা পয়েন্ট অব কন্টাক্টের ডিটেইলস। অবাক করার বিষয় এখানেই যে, এই কাগজগুলো আমাকে দেয়া হয়েছিল জাপানে পা রাখার তিনমাস আগে। তিন মাস! অনেক দেশে আগের দিনেও জানা যায় না টাইম টেবিল, নিশ্চিত হয় না কে হচ্ছেন ‘পয়েন্ট অব কন্টাক্ট’।

একসময়ে প্রচণ্ড আত্মমগ্ন ও নীতিতে একরৈখিক এই উন্নত অত্যাধুনিক দেশ জাপান তথা ‘নিহন’। তাদের নিজস্ব ভাষা ‘নিহনগো’ ছাড়া সামান্য ইংরেজিটুকু ব্যবহারে এখনো ঘোর বিব্রত বোধ করে তারা। বিলবোর্ড, টাইম স্ক্রিন, লোকেশন সব নিহনগোতেই লেখা থাকে বেশিরভাগ সময়ে।

দেখতে দারুণ স্মার্ট ও শিক্ষিত কোন নিহনজিনকেও এক-দুই লাইন ইংরেজিতে সাহায্য চাইতে নিলে তাদের ভীষণ সংকোচ মেশানো অপারগতার বিনয়ী অভিব্যক্তিটি দেখে নিজেরই লজ্জা হয়। থাকরে বাবা! ক্যান যে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাই ভাষা না জানা যে কারোই এখানে খুব সমস্যা হবে, কোনো সন্দেহ নেই।

সেটা ভেবেই হয়তো, আমার সঙ্গে দেয়া ম্যাপগুলো ছিল। এয়ারপোর্টে পা রেখে কীভাবে ট্রেন স্টেশনে আসবো তার বৃত্তান্ত এবং ট্রেন স্টেশন থেকে কীভাবে ইন্সটিটিউটের নিজস্ব বাসটা পাবো সেটার ডায়াগ্রাম। একেবারে ভীষণ নিখুঁত এই ম্যাপ আমি পদে পদে মিলিয়ে অবাকই হয়েছি। আমার ফ্লাইটের টাইম টেবিল মিলিয়েই এটা বানানো।

একেকজন একেক সময়ে এসে ল্যান্ড করা বিভিন্ন দেশ আর মহাদেশের ৩৭ জন সতীর্থের সবার জন্য এভাবে আলাদা আলাদা করে ট্যুর প্ল্যান পাঠানো হয়েছিল। এতো সিনসিয়ারিটি, এতো যত্ন করে কিছু জানানো যেতে পারে কারো উপকারের জন্য তা ভাবাই যায় না। জাপানিদের সাধে এই বিশ্ববাসী এতো পরিশ্রমী হিসেবে শ্রদ্ধা করে না, এরা আসলেই কি পরিমান ডিটেইলসে কাজ করে, সেটার নমুনা আমার ওই এক তোড়া কাগজ।

কালক্রমে ট্রানজিট মিলিয়ে বিশঘণ্টা পথ চলে, তিনটা লাগেজ টেনে নিয়ে রাত নয়টায় ট্রেন স্টেশনের ওই নির্দিষ্ট স্পটে এসে দাঁড়ালাম। এটাই ক্যাম্পাসে পৌঁছাবার আগে জার্নির শেষ ধাপ। কাগজে পড়ে দেখি, ঠিক বারো মিনিট পর একটা ‘লালচে বাদামি মিনিবাস’ এই স্টপেজে এসে পড়ার কথা।

সত্যি বলি, পথে পথে সব ধাপ সুন্দর ভাবে পার করেও তখন একটুও বিশ্বাস হয়নি, আসলেই এই শুনশান নীরব যাত্রী ছাউনিতে কোন বাস এবেলায় আসবে। লালচে বাদামি বাস। হতাশ, শঙ্কিত ক্লান্ত পাখির মতো আমার ইচ্ছে হচ্ছিলো ডানা গুটিয়ে বসে পড়ি কোথাও, বন্ধ করি পাখা।

কিন্তু না, দূরপথের বাঁকে মোড় ঘুরিয়ে কাঁটায় কাঁটায় জাস্ট বারো মিনিট পর একটা বাস ঠিকই এসে হাজির। বাসের রং লালচে বাদামি, একেবারে যথা সময়ে, যেমনটা লেখা সেই বাসের টাইম টেবিলে।

আমি মুগ্ধ হলাম, প্রথমবারের মতো এবং অনন্তের জন্য। এই আট মাস আমাকে বিস্তর অবাক করার মিশনে থাকা এই ধন্যদেশ ‘নিহন’ ওই মুহূর্তেই আমাকে প্রেমে পড়িয়ে দিলো তার।

আরিগাতো গোজাইমাস!

(চলবে)

লেখক: সহকারী সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বর্তমানে ভাষা শিক্ষা কোর্সে জাপানে অবস্থানরত

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!