কুড়িয়ে পাওয়া বোতল বিক্রি থেকে আয়

জার্মানিতে প্রতিটা খালি পেট বোতলের দাম পঁচিশ সেন্ট আর কাঁচের ভারী বোতলের দাম আট সেন্ট।

নাঈম হাবিব, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2018, 05:25 AM
Updated : 22 April 2018, 11:15 AM

বাংলাদেশি টাকায় পঁচিশ সেন্ট মানে পঁচিশ টাকা আর আট সেন্ট মানে আট টাকা। দোকানে যে কোনো ধরনের পানীয় কিনলে বোতলের মূল্যও রাখা হয়, জার্মানিতে আসার পর এ ব্যাপারটি বুঝতে আমার কিছু সময় লেগেছিলো।

প্রতিটা বোতলের লেবেলে একটা বিশেষ চিহ্ন থাকে। সুপারমার্কেটে থাকে ডিজিটাল ভেন্ডিং মেশিন। পানীয় বোতল কেনার পর খালি হয়ে গেলে বাসাতেই একটা থলের মধ্যে জমাতে থাকি। এভাবে যখন আনেকগুলো জমে যায়, তখন সেগুলো নিয়ে সুপারমার্কেটে মেশিনে দেই।

মেশিনে বোতলের মাপ সদৃশ ছোট্ট একটা ছিদ্র থাকে। ওই ছিদ্র দিয়ে বোতল ঢুকিয়ে দিলেই মেশিনের স্ক্যানারের লেজার বোতলের লেবেলে মারলেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে বোতলের সঠিক দাম স্ক্রিনে ভেসে আসে।

মেশিনে সব বোতল দেওয়ার পর সুইচে টিপ দিলেই একটা দামযুক্ত রিসিট বের হয়ে আসে। যেটি টাকার মতোই ওই মার্কেটে ব্যবহার করা যায়। হয়তো মার্কেট থেকে বাজার করলাম পাঁচ ইউরোর মতো, আর বোতল জমা দিয়ে পেলাম দশ ইউরো। ক্যাশে ওই রিসিট জমা দিলে বাজারের মূল্য বাদে আমাকে পাঁচ ইউরো নগদ ফেরত দেবে। সম্পূর্ণ ঝামেলাহীন পদ্ধতিতে বোতলগুলো ফেরত দেওয়া যায়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আপনি যে মার্কেট থেকে বাজার করলেন, খালি বোতল আপনাকে ঠিক সে মার্কেটে ফেরত দিতে হবে না। অন্য যেকোনো মার্কেটে বোতল ফিরিয়েও টাকা ফেরত পাওয়া যায়। এমনকি এক শহরের বোতল অন্য শহরেও ফেরত দেওয়া যায়।

কেনাকাটার সময় যেহেতু বোতলের মূল্যও দিতে হয়, সেহেতু বোতল ফিরিয়ে পাওয়া টাকাকে তো আর আয় বলা যাবে না। তো আয় কীভাবে হলো? এখন আসি সে গল্পে।
জার্মানি আসার পর প্রথম প্রথম নিজের খালি বোতল দোকানে ফিরিয়ে নিতেও লজ্জাবোধ করতাম। এ কাজকে অতিরিক্ত একটা ঝামেলা মনে হতো। পরে বুঝলাম, এতো লজ্জার কিছু নেই। সবাই তো এমন করছে।

তাছাড়া, এগুলো তো ফেলে দেওয়া যাবে না। ফেলে দেওয়া মানে নিজের টাকা ফেলে দেওয়া। একটা খালি পেট বোতলের দাম ধরা হয় পঁচিশ সেন্ট। আর একটা ব্রেডের দাম মাত্র তেরো সেন্ট।

চারটা খালি বোতলের দাম এক ইউরো। আর এক ইউরো মানে এখানে অনেককিছু। দেড় কেজি আলুর দাম এক ইউরো। চারটা খালি পেট বোতল আর দেড় কেজি আলুর দাম সমান। এক কেজি সস্তা চালের দাম এক ইউরো।

কিন্তু অনেকে আছে খালি বোতল রাস্তায় যেখানে সেখানে ফেলে দেয়। এরা হচ্ছে কমবয়সী স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে। যাদের এখনো মা-বাবার হোটেলে খায়। যারা এখনও বাইরের দুনিয়ার রঙ দেখেনি।

ফেলে দেওয়া খালি বোতল কুড়ানোর লোকের আবার জার্মানিতে অভাব নাই। বোতলের মূল্য নির্ধারণ করা থাকাতে সাধারণত কেউ এগুলো রাস্তাঘাটে খালে-বিলে, নদীতে ফেলে না। আর যদি কেউ ব্যস্ততায় ফেলেও দেয়, কেউ না কেউ সেটিকে কুড়াবেই। আর এতে করে শহর দূষণমুক্ত তথা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বজায় থাকবে। আর হয়তো এটাই কর্তৃপক্ষের মূল উদ্দেশ্য।

খালি বোতল মেশিনে দিলে বোতল সম্পূর্ণ খালি হতে হবে। যদি ভেতরে অল্প পানি থাকে তাহলে সেটি মেশিন নেবে না। তখন ব্যস্ততায় বা বিরক্তি হয়ে কেউ কেউ মেশিনের পাশের ডাস্টবিনে বোতল ফেলে দেন।

একবার এক বুড়ো বয়সী জার্মান লোককে ডাস্টবিনের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে খালি বোতল খুঁজতে দেখি। আর তা দেখে আমার একটু কেমন লাগে, মায়া হয়। বোতল বিক্রি থেকে পাওয়া চার ইউরো সমমান একটা রিসিট আমি তাকে দিয়ে দেই।

ইউরো পেয়ে কিছুক্ষণ তিনি আমার দিকে বাচ্চাদের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। হয়তো মনে মনে কতোকিছুই বলেছেন, বিদেশিরা অনেক ভালো, বাদামী লোক অনেক ভালো। যেতে যেতে ‘ডানকা’, মানে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন।

আমার বাসা থেকে নিকটতম সুপারমার্কেট পায়ে হেঁটে দশ মিনিট। যেতে হয় একটি স্কুল অতিক্রম করে। প্রায়ই স্কুলটির আশেপাশে অনেক খালি বোতল পড়ে থাকতে দেখা যায়। অনেকে সেগুলো কুড়িয়েও থাকেন। ইচ্ছে হলেও লোকের সামনে কখনো সেগুলো উঠাইনি। লজ্জা লাগে।

একদিন সন্ধ্যাবেলা স্কুল পথ ধরে মার্কেটে যাচ্ছিলাম। স্কুলের আশেপাশে দেখি টাকার মতো অনেক খালি বোতল এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জার্মানিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চিন্তা মাথায় নিয়ে আমি সেখানে একটু স্বেচ্ছাশ্রম দেই। সেগুলোকে একটি থলের মধ্যে নেই। গুণে দেখি সর্বমোট বোতল ছিলো ৩৩টি। সেগুলোকে মার্কেটের রিসাইকেলিং মেশিনে দিয়ে আমি পাই আট ইউরোর উপরে।

আমি মার্কেট থেকে বাজার করেছিলাম পাঁচ ইউরোর মতো। কুড়িয়ে পাওয়া বোতল বিক্রির আট ইউরো থেকে বাজারের পাঁচ ইউরো পরিশোধ করেও আমার তিন ইউরোর মতো বেঁচে যায়। সেই থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই পা এই স্কুল পথ ধরেই যায়। 

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইলmd.naim@aol.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!