তেলপত্রের ছাতা: চীনা ঐতিহ্যের ধারক

ছেলেবেলায় চীন দেশের নারীদের যেসব ছবি বিভিন্ন পোস্টার কিংবা বইয়ের পাতায় দেখতাম, সেখানে তাদের সুদৃশ্য নকশা করা লম্বা পোশাকের সঙ্গে মাথায় ফুল কিংবা টুপি থাকত। সেই সঙ্গে তাদের হাতে থাকত অবশ্যই সুদৃশ্য নকশার একখানা ছাতা।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান খান, চীনের লুঝৌ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2018, 04:46 AM
Updated : 21 March 2018, 04:46 AM

পরে জেনেছি এ ছাতাকে ইংরেজিতে ‘অয়েল পেপার আমব্রেলা’ বলে। যদি ভুল না করে থাকি, ‘অয়েল পেপার আমব্রেলা’ বাংলায় হবে ‘তেলপত্রের ছাতা’। তাই হওয়ার কথা, তাই না?

চীনা ভাষায় একে ‘ইও-ঝি-স্যান’ বলে। বাংলা উচ্চারণ নিয়ে আবার চীনা ভাষার পণ্ডিতরা কিছু মনে করবেন না। একে তো অঞ্চলভেদে উচ্চারণ ভিন্ন, তার উপর আবার বঙ্গানুবাদ!

চীনে আসার আগে ভেবেছিলাম চীনের রাস্তায় কিংবা অন্দরে বইয়ের পাতায় দেখা সেইসব নারীরা ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু এসে দেখি ভিন্ন ব্যাপার-স্যাপার। সেইসব নকশা করা লম্বা কাপড় চীনা নারীদের শরীর থেকে বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই। পশ্চিমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চীনা নারীরাও ছোট ছোট পোশাক আপন করে নিয়েছে।

সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ‘ইও-ঝি-স্যান’ কিংবা ‘তেলপত্রের ছাতা’। শুধু বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে কিংবা কিছু বিয়েতে যারা এখনও নিজেদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে পছন্দ করেন, তাদের ক্ষেত্রে বাহারি এ ছাতার দেখা পাওয়া যায়।

আমি একবার এ ছাতা কিনতে গিয়ে এর দাম দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বিদায় নিয়েছিলাম। বেশ অবাকই হয়েছিলাম। কী আছে এ ছাতায় যে এমন দাম! শুধু সুন্দর নকশার জন্য এত দাম! আসলে ঠিক এ কারণেই চীনা ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক তেলপত্রের এ ছাতা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

এর উৎপাদন খরচ অনেক বেশি, যা আধুনিক ছাতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। তবে ভালো খবর হচ্ছে, এর কারিগররা আবার নতুন উদ্যামে ফিরে আসছেন। চীন তথা বিশ্ববাজারে এর চাহিদা বাড়ছে, উপহার-সামগ্রী হিসেবে আবার নতুন করে সমাদৃত হচ্ছে।

প্রায় দুই হাজার বছর আগে চীনে এ ছাতা ব্যবহারের প্রচলন শুরু হলেও পরবর্তীতে এর কদর ছড়িয়ে পড়ে জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। এসব দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতেও তেলপত্রের সুদৃশ্য এ ছাতা মিশে গেছে। প্রাচীন চীনে ‘হাক্কা’ সমাজে বিয়ের সময়ে কনেকে ছাতা উপহার দেওয়া হত, আর এর আশীর্বাদস্বরূপ অর্থ ছিল ‘তোমার অতি শীঘ্রই সন্তানলাভ হোক’।  

যাই হোক, বর্তমানে অল্প কয়েক জায়গায় এ ছাতা তৈরি হয় এবং তার মধ্যে সিচুয়ানের লুঝৌ শহরের ফেনসুই এলাকা একটা। সম্প্রতি আমার এক চীনা বন্ধু আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এ ছাতার কারখানা দেখার জন্য। বেশ ভালো লাগল। আমরা শুধু ছাতা আর এর সৌন্দর্যকেই দেখি, কিন্তু এর পেছনে কি নিরন্তর পরিশ্রম, সাধনা আর দক্ষতার দরকার তা না দেখলে বুঝতাম না। আরো বুঝলাম, যে দামে বাজারে ছাতা বিক্রি হয়, তা নিতান্তই অযৌক্তিক নয়।

মূল কাঠামো সাধারণত বাঁশের। এর সঙ্গে থাকে অসংখ্য সুতোর কারুকার্য। তার উপর বিশেষ এক ধরনের উদ্ভিজ্জ তেলমাখানো কাগজ সেঁটে দেওয়া হয়। সেই কাগজে আগেই নকশা করা হয়। তারপর রোদে শুকানো। সুতোর কারুকার্যটাই নাকি মূল, এবং এর উপর ভিত্তি করেই দাম বেশি কম হয়।

কারখানার মালিক সাহেব আমাকে পেয়ে খুশি হলেন। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালেন। সেদিন আবার একটা স্কুলের অনুষ্ঠান ছিল। ছাতায় নকশা করা আর ছাতা বানানোর দীক্ষা। ফুলের মতো সুন্দর শিশুরা একাগ্র মনে ছবি এঁকে সুন্দর সব ছাতা বানাচ্ছে, দেখতেই ভালো লাগে।

চীনারা বরাবরই সৌন্দর্যপ্রিয় জাতি। এদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে খুব বেশি ফুল, পাখি, নদী, ঝরনা ইত্যাদি মিশে আছে। তারই রূপ এরা তেলপত্রের ছাতায় ফুটিয়ে তোলে।

লেখক: চীন প্রবাসী

ইমেইলঃ asadkhanbmj@yahoo.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!