সাইপ্রাসে বাংলাদেশি প্রবাসীরা যেখানে কাজ করেন

আমাদের দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রতি বছর ছাত্র ভিসা নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তার মধ্যে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর উদ্দেশ্য থাকে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।

মাহাফুজুল হক চৌধুরী, সাইপ্রাসের নিকোশিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2018, 05:50 AM
Updated : 11 March 2018, 05:50 AM

বর্তমানে আমাদের দেশের চাকরির বাজারের যা করুণ অবস্থা, শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষিত লোক তাদের যোগ্যতা অনুসারে চাকরি পাচ্ছে না। তাই এখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষ হতে না হতেই কর্মজীবন গড়ার জন্য বেছে নিচ্ছে ইউরোপ -আমেরিকার দেশগুলোকে।

এক বুক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে অনেক কষ্টের বিনিময়ে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে তারা বিদেশে পাড়ি জামাচ্ছে। এখন কথা হলো, আসলে বিদেশে তারা কতোটা সফলতা লাভ করতে পারছে?

বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ -আমেরিকায় যেসব শিক্ষার্থীরা আসতে চায়, আমি আজ তাদের জন্য আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। আমি যেহেতু ইউরোপ মহাদেশের ছোট্ট একটা দ্বীপ রাষ্ট্র সাইপ্রাসে আছি, সেই হিসেবে ইউরোপের বাইরের দেশগুলো সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নাই। তাই আমি ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো ও সাইপ্রাসের বর্তমান পরিস্থিতির উপর আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।

বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রথম পছন্দনীয় দেশ হিসেবে ইউরোপের জার্মানি, নরওয়ে, সুইডেন, ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্কসহ আরও কিছু দেশ বেছে নেয়। এই দেশগুলোতে ভিসা পাওয়া খুব কঠিন হওয়ায় যারা এসব দেশের ভিসা পেতে ব্যর্থ  হয়, তারা পরে ইউরোপের দ্বিতীয় সারির দেশগুলোকে বেছে নেয়।

এই দ্বিতীয় সারির দেশগুলোর মধ্যে সাইপ্রাসে ভিসা পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ হওয়ার কারণে অনেকেই আবার সাইপ্রাসকে বেছে নেয়। তবে এখন সাইপ্রাসের ভিসা পাওয়াও খুব কঠিন হয়ে পড়ছে।

আমি  সাইপ্রাসে থাকি, তাই সাইপ্রাস নিয়েই কথা বলি। এই দেশের পরিচিতি নিয়ে আমি বেশি কিছু বলব না। ভূ-মধ্য সাগরের মাঝে অবস্থিত ছোট্ট একটা দ্বীপ রাষ্ট্র এটা। এখানে আমরা প্রায় ৫ হাজারের মতো বাংলাদেশির বাস, তার মধ্যে ৮০ ভাগই ছাত্র ভিসা নিয়ে এসেছে এখানে। বাকি ২০ ভাগ অন্যান্য কাজে আসা। আবার কেউ কেউ নর্দান সাইপ্রাস হয়ে আসা এখানে। নর্দান সাইপ্রাসটা আবার তুর্কি সাইপ্রাস নামেও পরিচিত।

নর্দান সাইপ্রাসটা নিয়ে একটু বলি। ১৯৭৪ সালে তুরস্ক ইউরোপিয়ান সাইপ্রাস থেকে একটা অংশ কেড়ে নিয়েছিল। সেই থেকে ওই অংশ তুরস্ক সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। দেশ দুইটা ভাগ হয়ে গেলেও বর্ডার এক হওয়ায় তুর্কি সাইপ্রাস থেকে অনেকেই রাতের অন্ধকারে ইউরোপিয়ান সাইপ্রাসে ঢুকছে। দালালকে বাংলাদেশি ২০-৩০ হাজার টাকা দিলে নর্দান সাইপ্রাস থেকে ইউরোপিয়ান সাইপ্রাসে ঢুকিয়ে দেয়।

আরও  একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সবাইকে জানিয়ে রাখি- ইউরোপিয়ান সাইপ্রাসে যে সকল ভিসাধারী শিক্ষার্থীরা আছে, তারা তুর্কি সাইপ্রাসে আনায়াসে যাতায়াত করতে পারে, কিন্তু তুর্কি সাইপ্রাসে যারা আছে ,তারা ভিসা থাকলেও ইউরোপিয়ান সাইপ্রাসে ঢুকতে পারে না।

এইবার আমি সাইপ্রাসের কলেজের কিছু নিয়মকানুন ও শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে বলি। এখানে কীভাবে আসা যায়, তা আমার না বললেও চলবে। হয়তো এ ব্যাপারে সবার কমবেশি ধারণা আছে।

সাইপ্রাসে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে প্রায় ৩০টির মতো উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইন্টারেনেটে খুঁজলে সবগুলো সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাবে। সাইপ্রাসে ব্যাচেলর করার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম বলি।

এখানে প্রায় কলেজগুলোতে টিউশন ফি ও অন্যান্য নিয়মকানুন প্রায় একই। প্রথম বার বাংলাদেশ থেকে আসার সময় এক বছরের টিউশন ফি দিতে হয়। এক বছরের টিউশন ফি ৪ হাজার ২০০ ইউরো, মানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

এইবার পরের বছর থেকে প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই হাজার ইউরো টিউশন ফি দিতে হয় এবং প্রতি বছর নতুন করে ভিসা লাগাতে হয়। ভিসা লাগাতে হলে বছরে দুই সেমিস্টারে মোট ১২টি বিষয়ের মধ্যে কমপক্ষে ছয়টি বিষয়ে অবশ্যই পাশ করতে হবে। তা নাহলে সাইপ্রাস ইমিগ্রেশন ভিসা দেয় না, তবে এই ক্ষেত্রে কলেজগুলো শিক্ষার্থীদের অনেক সুবিধা দেয়। যেমন- কেউ যদি দুই সেমিস্টারে মিলে ছয়টি বিষয়ে পাশ করতে না পারে, তাহলে ভিসা লাগানোর সময় কলেজ ছয়টিতে পাশ দেখিয়ে ভিসা করিয়ে নেয়।
তবে পরে ওই বিষয়গুলোতে আবার পরীক্ষা দিতে হয়। প্রতি বিষয়ের জন্য প্রায় ১২০ ইউরো জরিমানা রাখা হয়। আর কলেজে ক্লাস তো করতেই হয়।

এতক্ষণ তো কলেজ নিয়ে বললাম, এইবার বলি এইখানে থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে খরচ কেমন? ইউরোপের অন্যন্যা দেশগুলর তুলনায় শুধু ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় সাইপ্রাসে থাকার খরচ অনেকটা কম বললেই চলে। আপনি যদি খুব কম খরচের মধ্যে থাকতে চান, তাহলে থাকা-খাওয়া মিলিয়ে মাসে ১২০ ইউরো বা তার কমে হয়ে যাবে। আর যদি মধ্যমানে থাকতে চান, তাহলে ২২০ ইউরোর মধ্যে হয়ে যাবে, যা ইউরোপের আর কোনো দেশে সম্ভব নয়।

আর যদি বিলাসবহুলভাবে থাকতে চান, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। মোট কথা হলো, কলেজের টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া মিলিয়ে প্রতি বছর সর্বনিম্ন ৪ হাজার ইউরোর উপরে খরচ আছেই। নিজেরও তো কিছু টুকিটাকি খরচ করতেই হয়।

এইবার আসি সাইপ্রাসে চাকরি ব্যবস্থা সম্পর্কে। সাইপ্রাস একটি ইউরোপের দেশ হলেও দেশটি অত্যন্ত ছোট হওয়ায় এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ কর্মসংস্থান নাই। এমনকি সাইপ্রাসের ৪০ শতাংশ লোকের ভালো কোনো কর্মসংস্থান নাই।
অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, কাজের এত অভাব হলে আমরা যারা প্রবাসী আছি, তারা কীভাবে চলি? হ্যা, কাজের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রে সাইপ্রাসে এশিয়ানদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশিদের কর্ম দক্ষতা এবং সততা। তবে নতুনদের কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক কষ্ট হয়।

অনেকদিন কাজ খুঁজতে হয়, এমনকি অনেকের কাজ খুঁজতে খুঁজতে বছর লেগে যায়। আবার অনেকেই সাইপ্রাস আসার সাথে সাথে খুব অল্প সময়ে ভাল কাজ জোগাড় করে ফেলে। তবে একটা মজার বিষয় হলো, সবসময় ভালো কাজ থাকলে ভালো টাকা উপার্জন করা যায়। যেমন- অনেকেই বছর শেষে খরচ বাদ দিয়ে ১০ থেকে ২০ হাজার ইউরো সঞ্চয় করতে পারে (৯ লাখ থেকে ১৮ লক্ষ টাকা বাংলাদেশি টাকায়)। তবে এই ক্যাটাগরির লোক আমরা বাংলাদেশিদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ।

আবার কেউ কেউ মাসে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকাও আয়  করে, সেটা ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবসার উপর নির্ভর করে। কিন্তু এই ক্যাটাগরির লোক খুব কম বললেই চলে। আবার অনেকের আয়-ব্যয় বাদ দিয়ে বছর শেষে কিছুই থাকে না। এই ক্যাটাগরির লোকও কম নয়। শতকরা প্রায় ২০ ভাগ লোক আছে এই ক্যাটাগরিতে। আবার অনেকেই কোনো কাজই করে না, দেশ থেকে এনে খায়। তাদেরটা ভিন্ন বিষয়।

এইবার বলি কোন কোন সেক্টরগুলোতে ছাত্ররা বেশি কাজ করে। বেশিরভাগ ছাত্ররা এখানে রেস্টুরেন্ট ও ডেলিভারির কাজ করে, ওইসব কাজে ঘণ্টায় ৪-৬ ইউরো বেতন পাওয়া যায়। আবার অনেকেই কৃষি বিষয়ক কাজ করে,ওইসব কাজেও ঘন্তায় ৫-৭ ইউরো বেতন আছে। আর গ্রোসারির দোকানেও অনেকেই কাজ নেয়, এক্ষেত্রে বেতন মাস হিসেবে দেওয়া হয়।

আবার কেউ কেউ আছে ওয়ার্কসপ লাইনে। তবে এই লাইনে অনেক অনেক কম বললেই চলে, তার কারণ হচ্ছে- কাজ না জানলে সাইপ্রাসে ওয়ার্কসপ লাইনে কেউ কাজ দেয় না। আর এশিয়ানরা কাজ জানে না, যার কারণ এই লাইনে কাজ পাওয়া যায় না।

হ্যা, তবে ওয়ার্কসপ লাইনেই হচ্ছে সাইপ্রাসে সবচেয়ে বেশি টাকা আয়  করার একমাত্র সোর্স আমাদের জন্য। একজন কাজ জানা ভালো দক্ষ মিস্ত্রী চাইলে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩ হাজার ইউরোর উপর আয় করতে পারে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আড়াই লাখ টাকার উপরে।

এখন হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে সবাই ওই লাইনে কাজ করে না কেনো? আমি আগেই বলেছি, কাজ না জানলে এই লাইনে কাজই দেয় না কেউ। আর কাজ পেলেও অনেকেই বেশিদিন টিকতে পারে না, কাজ শেখাও অনেক কষ্ট। আমি বর্তমানে এই লাইনে একজন কার পেইন্টার হিসেবে সাইপ্রাসে কর্মরত আছি।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!