অবশ্য আমরা যে সময়টাতে দেখেছি, তাতে নিজ চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা মুশকিল। উচ্চতা তো দূরের কথা, একথা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হবে যে ওটা আসলে একটা জলপ্রপাত।
অনেকে বলে, জলপ্রপাত দেখার জন্য শীতকাল মোটেও ভালো সময় নয়। কিন্তু সত্যি বলতে- ভালো সময়, মন্দ সময় যাচাই করার সুযোগ আমাদের ছিল না। অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম - বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলেই কোথাও ঘুরতে যাব। শীতকালীন ছুটির সময় যেহেতু দেশে যাচ্ছি না, এখানে এমন কিছু করে কাটাতে হবে, যাতে অবসর সময়ে ‘হোম সিকনেস’ ভর না করে।
আমাদের ডাচ-বাংলা-চাইনিজ টিমের সবচেয়ে সক্রিয় বন্ধু গাওমিং পঞ্জিকা ঘেটেঘুটে ভ্রমণের জন্য শুভদিন হিসেবে ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ ঠিক করলো। ২৩ তারিখে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গাওমিং-এর কথা না মেনে উপায় নেই। কেননা, আমাদের মধ্যে একমাত্র গাওমিংই ফরাসী ভাষায় কথা বলতে পারে। ওই জায়গাগুলো সম্পর্কে ওর ধারণাও আছে।
২৩ তারিখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরেকটা কারণ, আমরা কলা বেচা এবং রথ দেখার কাজটা একসাথেই সারতে চেয়েছিলাম। কুইবেক সিটিতে বড়দিন উপলক্ষে ‘ওপেন মার্কেট’ বসেছে। ২৩ তারিখ শেষদিন। তাই মনমরেন্সি জলপ্রপাত এবং কুইবেক সিটি ভ্রমণ একদিনেই রেখেছি।
আমাদের বাস যেখান থেকে ছেড়েছে, সে জায়গাটার নাম মনে পড়ছে না। সম্ভবত ‘ভিগর স্ট্রিট’। ভোর ৫টার সময় উঠে সাড়ে ৫টার মেট্রো ধরে ভিগড় স্ট্রিটে যখন পৌঁছেছি, তখন ৬টা বেজে পনেরো মিনিট। বাস ছাড়বে ৭টায়। বাস তখনও স্টেশনে আসেনি। অন্যান্যরাও তখনও এসে পৌঁছায়নি। আমি অতি সতর্কতার জন্য আগেভাগে গিয়ে এখন ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি।
সাজ্জাদকে ফোন দিলাম। সাজ্জাদ জানালো, মিনিট দশেকের মতো লাগবে। ওই সময়টাতে আমি প্যাকেটে মোড়ানো আইসক্রিম হয়ে গেছিলাম। বাসে উঠে বসার পর একটু স্বস্তি পেলাম। কুইবেকের উদ্দেশ্যে বাস যখন ছাড়লো, তখনও মন্ট্রিয়লে সূর্য উঠেনি।
আবেগ নিয়ন্ত্রণের একটা বড় উপায় কিছু খাওয়া। তাই সাথে নিয়ে আসা সকালের নাস্তা করলাম। বন্ধুদেরকে ওয়েফার দিলাম। চকলেট মোড়ানো ওয়েফার পেয়ে সবার খুশি দেখে মনে হলো- ওয়েফার কেনার সিদ্ধান্ত যথার্থ ছিল।
বাস চলতে চলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়ালই করিনি। ভোরবেলায় বাস ধরতে হবে বলে ঘুম ভেঙে গেছিলো গভীর রাতেই। রাতে ঘুমাতে গিয়েছিলামও দেরিতে। তাই শরীর তার সুযোগ মতো ঘুমের ঘাটতি পূরণ করে নিচ্ছে।
ঘুম ভাঙলো ‘ট্যুরিস্ট গাইড’-এর ‘মাইকিং’ শুনে। ‘ওয়াশরুম’ বিরতি। যদিও বাসে টয়লেট আছে। তবুও এই বিরতি যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করেই। আমাদের দেশের বাসগুলোতে যে কবে টয়লেট বসাবে!
মনমরেন্সি জলপ্রপাতের কাছে যখন পৌঁছালাম, তখন ছোটখাটো তুষার ঝড় চলছে। যেমন বাতাস, তেমন তুষার। চোখে মুখে এসে লাগছে, তাকাতে পারছি না। এর মধ্যেই কখনও পিছন ফিরে, কখনও মুখ লুকিয়ে হেঁটে অবশেষে তার কাছাকাছি গেলাম। জন কিটস্রে ‘স্লিপ অ্যান্ড পোয়েট্রি’ কবিতার মনমরেন্সি নদীর ওপর অবস্থিত বিখ্যাত সেই জলপ্রপাতের কাছে।
আমরা মনমরেন্সির ওপর যে সেতুটি রয়েছে সেখানে থেকেই উপভোগ করার চেষ্টা করছি। ছবি তোলার জন্য দুই-একবার যখন হাত বেপ করছি, আঙুলগুলো অবশ হয়ে যাচ্ছিলো। পুরো এলাকাটি বিভিন্ন দিক থেকে ঘুরে দেখার জন্য বেশ কয়েকটা সিঁড়ি রয়েছে। আমরা আর সিঁড়ি দিয়ে নামার সাহস পেলাম না। সিঁড়িগুলো তুষার এবং বরফে এমনভাবে ঢেকে আছে যে এর ধাপগুলো বোঝা যাচ্ছিলো না।
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ জমে যাওয়া জলপ্রপাত দেখে হতাশ হলেও আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। প্রবল স্রোতে শো শো শব্দে যার প্রবাহিত হওয়ার কথা, সে এখন প্রবল শীতে বরফের নিচে মুখ লুকিয়ে ধীরে ধীরে চুইয়ে চুইয়ে নামছে। পানির প্রবাহকে দেখাচ্ছে সাদা সাদা মেঘমালার মতো।
এত ঠাণ্ডার মধ্যেও কোকড়া চুলের মতো দেখতে সাদা রঙের বরফাচ্ছাদিত জলপ্রপাত দেখতে দেখতে আমাদের গাইড জানিয়ে দিল, আমাদের সময় শেষ। এখন যেতে হবে কুইবেক সিটিতে। আমরা কুই কুই করতে করতে আবার বাসে এসে বসলাম। গন্তব্য কুইবেক সিটি। এ গল্প আরেকদিন।
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |