এটি নেহায়েত কম সময় নয়। সে আলোকেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বিভিন্ন পেশায় সফল বাংলাদেশি ১৩ জনের মতামত জানতে চাওয়া হয় বিজয়ের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির আলোকে-
জিল্লুর আর খান
‘গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত কী?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসন নিশ্চিত করা, মানুষের প্রাপ্য নিশ্চিত করা এবং ক্ষমতায় ভারসাম্য রাখা। ব্যক্তির হাতে সব ক্ষমতা থাকলে গণতন্ত্র বিপন্ন হতে বাধ্য। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, গণতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত রাখতে ‘ইয়েস ম্যান’দের ওপর ভরসা করা চলবে না।”
ফ্লোরিডার ওরল্যান্ডোতে বসবাসরত এ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তার লেখা মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বইটি পড়ার জন্য সবাইকে সুপারিশ করেন।
তিনি বলেন, “বিজয়ের ৪৬ বছরে বাংলাদেশের মানুষ অনেক কিছুই দেখেছে। যার অবিচল নেতৃত্বে আস্থা রেখে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তেমন বিশাল হৃদয়ের মানুষটিকেও কতিপয় বাঙালির নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছে।”
‘এরশাদের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী হবার প্রলোভন’ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন জানিয়ে জিল্লুর আর খান আরও বলেন, “এরশাদ চেয়েছিলেন গণতন্ত্রকে সামরিকীকরণ করতে। ফলাফল সবাই দেখেছি নব্বইয়ের ডিসেম্বরে। এরপর ২৭ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। সত্যিকারের সুশাসনের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এবারের বিজয় দিবসে সে আকুতিই উচ্চারিত হবে বাঙালির হৃদয়ে।”
ফাইজুল ইসলাম
‘৪৬ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন কী?’ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “অর্থনৈতিকভাবে ন্যায়সঙ্গত অগ্রগতি সাধিত হলেও রাজনৈতিক সমৃদ্ধির প্রত্যয় এখনও পূরণ হয়নি। সম্প্রতি আমরা নিম্ন-আয়ের স্ট্যাটাস ডিঙ্গিয়ে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছি। চলতি দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কার্যকরভাবেই অর্জিত হয়েছে, যা ৬% এর ওপর। তবে আইনের শাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘আংশিক মুক্ত’ ইকনোমির সূচকে রেখেছে হ্যারিটেজ ফাউন্ডেশন।
“তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশ ধীর পায়ে এগুলেও, সঠিক গন্তব্যেই পৌঁছবে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরেক থিঙ্কট্যাংক ‘ফ্রিডম হাউজ’র মতে, রাজনৈতিক অধিকার এবং মানবাধিকারের ক্ষেত্রেও আংশিক মুক্ত। আমি আশা করছি, বাংলাদেশের দুর্নীতি কমবে, সুশাসন আসবে। একইসঙ্গে বিকাশমান গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে।”
মাহমুদ হাসান
বিজয় দিবসের অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেন, “সমসাময়িক বিশ্বের তুলনায় অর্থনীতি, তথ্য-প্রযুক্তি এবং আইনের শাসনের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছি আমরা। গত ৪৬ বছরে আরও অনেক অগ্রগতি হওয়া উচিত ছিল। এর মূল কারণ হচ্ছে, রাজনীতিকদের মধ্যে জাতীয় স্বার্থ ও ঐক্যের অভাব।”
‘স্বাধীনতার প্রত্যাশা পূরণে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা কতোটুকু?’ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “রাজনীতিকরা যদি মানুষের সত্যিকারের কল্যাণে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেন, তাহলে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি কেউই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। রাজনীতিকদের মধ্যে এ দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখে আমলারা স্বার্থ হাসিল করছেন। বলা যেতে পারে আমলাদের কূটকৌশলের শিকার হয়েছেন রাজনীতিকরা। এ পরিাস্থিতির উত্তরণ ঘটলেই বিজয়ের প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে মনে করছি।”
গোলাম মাতবর
তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশ এখন মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির জন্যে সংশ্লিষ্ট মহলে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের সত্যিকার বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে এ এক অন্যরকম অন্তরায়।”
জিয়াউদ্দিন
‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা কী ছিল?’ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের লাঞ্ছনা, অপমান, শোষণ, বারবার গণতন্ত্রের প্রত্যাখ্যান ও শেষ সময়ে ৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বাঙালিদের দাবিয়ে রাখার বিরুদ্ধে। আকস্মিকতায় বিমূঢ় প্রাথমিক মুক্তিযুদ্ধের একটাই প্রত্যাশা ছিল, ‘স্বাধীনতা’।”
‘মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রত্যাশা কী’ এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “অবশ্যই দেশে একটা সুন্দর শোষণহীন, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রত্যাশিত ছিল সব রাজনৈতিক দলের কাছে। নিজস্ব পরিমণ্ডলে তাদের বিশ্বাস তারা হয়তো যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন, তবে আমরা সাধারণ মানুষ এখনও সেটা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারছিনা। আমার বিশ্বাস স্বাধীতনার সুফল বা তার পূর্ণাঙ্গ স্বপ্ন কোন সরকার বা রাজনৈতিক দল কখনো দিতে পারবে না, যদিনা সাধারণ মানুষ নিজ নিজ জায়গা থেকে তাতে অংশগ্রহণ করেন।
নাজলী কিবরিয়া
বিজয় দিবসের অনুভূতি জানিয়ে তিনি বলেন, “বিজয় দিবস হচ্ছে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এ দিবসের চেতনায় সবাইকে একযোগে কাজ করা উচিত। আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি এ বিজয়ের জন্য আত্মত্যাগকারী সবাইকে।”
ইবরুল চৌধুরী
‘কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?’ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ৪৭তম বিজয় দিবসে জানাই সবাইকে শুভেচ্ছা। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা, সঠিক গণতন্ত্র, দুর্নীতিমুক্ত ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি সুন্দর বাংলাদেশ দেখতে চাই।”
কাদেরী কিবরিয়া
‘বিজয় কীভাবে পরিপূর্ণতা পাবে?’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “একটি স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। তবে দেশে এখন যে হারে দুর্নীতি আর বাটপারি চলছে, তা খুবই বেদনাদায়ক। এ অবস্থার অবসান ছাড়া বিজয় পরিপূর্ণ হতে পারে না।”
নিউ ইয়র্কে বসবাসরত কণ্ঠযোদ্ধা শহীদ হাসান।
তিনি বলে, “প্রত্যাশা ছিল ১০০। ৪৬ বছর পর প্রাপ্তির হার মায়নাস ১০০। যে প্রত্যাশায় আমরা জীবন বাজি রেখে বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, তা আজও পূরণ হয়নি।
অশোক কর্মকার
বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়ে তিনি বলেন, “মানুষের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে জীবনমানেরও কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখার ক্ষেত্রে কোন সরকারই আন্তরিক অর্থে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। বরং সংখ্যাগরিষ্ঠদের খুশি করতে প্রতিটি সরকারই প্রতিযোগিতা করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় নিরব থেকেছে। অথচ বিজয় দিবসের চেতনায় ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সবার সম-অধিকার নিশ্চিত করার কথা। বাংলাদেশ যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির হিসেবে দাবি করছে, তারা মূলত আত্মপ্রবঞ্চক। বিজয়ের প্রত্যাশা এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে সর্বসাধারণের কাছে।”
মঈন চৌধুরী
‘বিজয়ের প্রত্যাশায় বড় বাঁধা কী?’ এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আইনের শাসন ছাড়া বিজয়ের প্রত্যাশা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তা সুসংহত হয়নি। এমনকি, বর্তমানে সরকারি দলের লোকজনও ভীতির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। একইভাবে, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হওয়া দূরের কথা, অনেক বেড়েছে। ঘুষ-বাণিজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে প্রশাসন। এসব থেকে মুক্ত হতে পারলেই বিজয়ের প্রত্যাশা পূরণ হবে।”
মো. রফিকুল ইসলাম
তিনি বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। তবে যতটা হওয়া দরকার ছিল তা দেখতে পাচ্ছি না। এর অন্তরায় হচ্ছে জবাবদিহি সরকার প্রতিষ্ঠায় জনসচেতনতার অভাব এবং জনগণের মধ্যে ঐক্যের সংকট। একাত্তরের চেতনায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে হবে।”
আবু হানিফ
তিনি বলেন, “প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দুটো ভিন্ন শব্দ হলেও, উভয়ই উভয়ের সম্পূরক। প্রথমে আমি প্রাপ্তি প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন বলেই আজ এ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছি। আমি যখন দেখি আমার প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রী আমেরিকার টপ আইটি কোম্পানিগুলোতে কাজ করছে এবং তাও আবার সুনামের সঙ্গে, তখন আমার মনে হয় প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তিটাই কেমন যেন বেশি।”
তিনি জানান, পৃথিবীর প্রথম সিটিজেন রোবট সোফিয়ার বাংলাদেশ আসা প্রমাণ করে আমরা প্রযুক্তিতে কতটা আগ্রহী। তার চেয়ে আনন্দের বিষয় সোফিয়ার আসার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা বানিয়েছিল কয়েকটি রোবট। আর এটা সত্যিই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জনগণের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |