গাড়ি থেকে নেমেই রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডে বড় করে লেখাটা চোখে পড়লো-‘বাইত আল লুবান রেস্টুরেন্ট’।ওমানি খাবারের জন্য এই রেস্টুরেন্টের সুখ্যাতি রয়েছে।
রেস্টুরেন্টের বাইরের কারুকাজ খুব সাধারণ, তিনতলা ভবন কিছুটা পুরাতন দিনের রাজবাড়ির মতো। রেস্টুরেন্টের ভেতরের কারুকাজে চোখ জুড়িয়ে যায়, অনেক পরিপাটি ছিমছাম একটা রেস্টুরেন্ট।
দেয়ালের ঝাড়বাতিগুলো আমাকে ঢাকার বাণিজ্যমেলার ইরানি স্টলগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। আরব সমুদ্রের মাত্রাহ সৈকতের খুব কাছাকাছি হওয়ায় সবমিলিয়ে রেস্টুরেন্টের পরিবেশটা অসম্ভব সুন্দর।
লুবান ওমানি খাবারের সাথে সম্পৃক্ত ঐতিহ্যবাহী পানীয়। ওমানিদের খুব প্রিয়, দেখতে অনেকটা নারিকেল পানীয়ের মতো, খেতে একটু আলাদা। তবে আমি চুমুক দিয়ে এই পানীয়ের ভক্ত হয়ে গেলাম।
এবার খাবার অর্ডার করার পালা। আমি মেন্যু পড়ছি আর দ্বিধায় পড়ছি। শুয়া, হারিশ, মিশকাক, মকব্যুস, থারিড লাহাম, আরশিয়া, ক্যামেল কারি ইত্যাদি ইত্যাদি- কোনটা অর্ডার করবো আমি? জানি না, সত্যিই জানি না।
যখন পুরো খাবারের মেন্যুর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবটাই অচেনা লাগে, তখন মনে হয়, আমি কোনো এক পরীক্ষার হলে বসে আছি, যার প্রশ্নপত্র পুরোটা অজানা। এই অবস্থায় আমার ক্ষুধা আরও বেড়ে গেছে। এখন মন চাইছে মাসুদকে বাংলায় বলি যে আমার বিরিয়ানী খেতে মন চাচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে লুবান রেস্টুরেন্টের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে বাঙালি গোছের একজনকে চোখে পড়ায় সে বাঙালি কিনা জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ায় আমার পরীক্ষার হলে প্রশ্ন কমন পড়ার মতো আনন্দ হচ্ছে।
ওমানিদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে হচ্ছে ‘শুয়া’। এটা ওমানিদের বিভিন্ন উৎসবে খাবার তালিকায় সবসময় গুরুত্ব পায়। মাটির নিচে, বিশেষ চুলায় বিশেষ প্রক্রিয়ায় খাসির মাংসে মশলা মিশিয়ে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়ে প্রস্তুত করা হয় এই খাবার, যা খেতে হয় অসাধারণ।
গম, ঘি, মুরগির মাংস মিশ্রিত আরেকটি চমৎকার খাবার হচ্ছে ‘হারিশ’, যা পরিবেশন করা হয় খেজুর থেকে তৈরি বিশেষ আচারের সাথে, রমজানে এর কদর সবচেয়ে বেশি।
‘মকব্যুস’ আর ‘ক্যাবসা’ প্রায় একই ধরনের। চাল, গরু, খাসি, মুরগি, উট-যে কোনোটার মাংস, তার সাথে সবজি আর মশলা একত্রে মিশিয়ে বড় থালায় পরিবেশিত হয়। সাথে থাকে টমেটো চাটনী।
প্রতিটি খাবারের ডিশ ছয় থেকে সাত রিয়েলের মতো। জহির ভাইয়ের কাছে বর্ণনা শুনে তো সবগুলোই একবার করে খেয়ে দেখতে মন চাচ্ছে। আজ নাহয় শুয়া দিয়েই শুরু করি, হারিশ আর মকব্যুসদের সাথে নাহয় আরেকদিন দেখা হবে।
কিছুক্ষণ পরই আমার ক্ষুধার্ত পেটের চাহিদা মেটাতে বড় থালায় শুয়ার রাজসিক আবির্ভাব ঘটায় আমি আর দেরি না করে খেতে আরম্ভ করলাম। শুয়া খাবারের ডিশে রাইস দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের তেহারির মতো।
ক্ষুধার্ত পেটে যা পড়বে তাই নাকি অসাধারণ লাগে, সেটা যে-যাই বলুক, এই শুয়া খাবারের স্বাদ এক কথায় বলতে গেলে সারাজীবন মনে রাখার মতো। এই খাবারে প্রচুর গোলমরিচ থাকে, এজন্য একটু হালকা ঝাঁঝালো লাগে। তবে রাইতা আর টমেটোর চাটনি মিশিয়ে খেতে অসাধারণ।
সব দেশের সংস্কৃতির একটা বড় অংশই হচ্ছে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার। সেখানে মিশে থাকে অনেক জীবনের গল্পকথা। দেশে দেশে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ আর তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের কিছুটা অংশও যদি না দেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, তাহলে এ জীবন ব্যর্থ বৈ আর কিছু নয়। এসব ভাবতে ভাবতে খাবার প্রায় শেষের দিকে। তবু তার স্বাদ যেন শেষ হয় না।
ওমানি ডেসার্টটাও বেশ ভালো লেগেছে। আমার পেটের উপর ক্রমাগত চাপ বেড়ে চলেছে, খাবারের স্বাদের জন্য। এই চাপটাকে উপেক্ষা করে গেলাম।
পেট শান্ত হয়েছে, এবার ফেরার পালা। জহির ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়িতে উঠে মাসুদকে ‘শুকরান’ বললাম। মাসুদ উত্তরে ‘আফওয়ান’ বললো। সাথে আরও কী কী যেন বললো, আমার বোঝার সাধ্য নাই।
ক্লান্ত লাগছে আমার। এই মুহূর্তে আর কিছু বোঝার আগ্রহও নাই। রুমে গিয়ে একটা ঘুম দিতে চাই।
গাড়ির জানালা দিয়ে আমি বাইরে তাকিয়ে আছি। এবার আমরা যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, সেটা আরব সাগরের পাশের রাস্তা। প্রায় তিন লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের দেশটির একটা বিশাল অংশই সমুদ্রের পাড়ে অবস্থিত। এর মধ্যে এই মাত্রাহ সৈকত থেকে আলসিব পর্যন্ত দৃষ্টিনন্দন সমুদ্র সৈকতের পাশেই গড়ে উঠেছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ওমানের রাজধানী মাস্কাট শহর।
শান্ত সাগরের নীল রঙের পানি আমায় সমুদ্রে নামার আহ্বান জানাচ্ছে। সেই দিকে তাকিয়ে কখন যে আমি একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, মাসুদের ডাকে ঘুম ভাঙলো। ডরমিটরিতে চলে এসেছি।
লেখক: মেডিকেল অফিসার, রিনাইসেন্স পিএসি ক্লিনিক, ওমান
ই-মেইল: dr.mrhossain87@gmail.com
এই লেখকের আরও পড়ুন
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |