বিদেশ ভালো: লন্ডনে বাঙালি নারীর পেশা যখন যৌনতা বিক্রি

এর আগে আমার লালবাতি পাড়ায় যাবার কারণ ছিলো নিতান্তই গবেষণা। অবিশ্বাসের দায় আপনার। প্রমাণেরও। কিন্তু লন্ডনে বাঙালি যৌনকর্মী খোঁজা, তাদের নিয়ে বিস্তারিত সাংবাদিকতা করা.. এটাই জীবনে প্রথম ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম।

রিনভী তুষার, লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2017, 12:23 PM
Updated : 15 Nov 2017, 05:02 AM

লন্ডন মামুলি জায়গা নয়। মামুলি লোকের না। লন্ডনে বাঙালি উত্তরাধিকার আছে। তাই লন্ডন নিয়ে কিছু বলতে, লিখতে, পড়তে সবসময়ই মনে রাখতে হয় ‘ওস্তাদ বামে প্লাস্টিক’। এসব ডিসক্লেইমার দেবার কারণ একটাই। এ লেখাটি শিরোনাম সর্বস্ব নয়।

আপনি দেশপ্রেমিক? কতোটা? ধরেন, আর বছর দুয়েক পরেই একটা ব্রিটিশ পাসপোর্ট হাতে পাবেন। লন্ডনে বেশ আছেন চাচার বাড়িতে। অনেকটা নিজেরই বাড়ি। ভালো একটা ইংলিশ জব করেন। পারবেন এমন অবস্থায় সব ছেড়েছুড়ে লোটা-কম্বলসহ বাংলাদেশে ফিরে যেতে? আপনি পারবেন কিনা জানি না। একজন পেরেছেন। শাহরিয়ার ভাই।

শাহরিয়ার ভাই তখন কেএফসিতে কাজ করেন। লন্ডনে আইন নিয়ে পড়েন। একদিন রাতে বাসায় ফিরছেন। এক সুন্দরি পোলিশ নারী উনার দিকে এগিয়ে আসলেন।

এসে বললেন- বিজনেস? শাহরিয়ার ভাই ভাবলেন সিরিয়াস কিছু।

উনি বললেন, হু। এটাকে নারী ‘ইয়েস’ ভেবে এগোতেই ভাই আমার টের পেলেন এই ‘বিজনেস‘ সেই ‘বিজনেস’ না। এই বিজনেস ‘বীজ-নেস’!

শাহরিয়ার ভাই আমার জীবনে দেখা অসাধারণ মানুষদের একজন। উনার মুখে এ গল্প শুনে লন্ডনের যৌনকর্মীদের বিষয়ে আমার একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো। সেই আগ্রহ সম্বল করেই এই যাত্রায়..

লন্ডনে সেক্স ইন্ডাস্ট্রি আপনি বুঝতে চান। বেশ ভালো কথা। নেটে সার্চ করলেন। গাদা গাদা রিপোর্ট পড়লেন। ইউনিভার্সিটির রিসার্চ-এ ইরফান খান-সহ ডুব দিলেন। ডকুমেন্টারি দেখলেন। তারপর বেশ বুঝে গেছেন ভাব নিলেন, ‘এই যেমন- আমি নেই আর কি!’

এরপর এসকোর্ট সার্ভিস, মাসাজ পার্লারে গেলেন। নিজের জ্ঞানসহ নিজের গালে জোরে একটা চড় খেলেন। ব্যাস, আপনি হয়ে গেলেন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট।

বহুসংস্কৃতির দিক থেকে লন্ডন পৃথিবীর অন্যতম সেরা শহর। এখানে বেস্ট এর বেস্টরাও সারাদিন দৌড়ের উপর থাকে। সেক্স ইন্ডাস্ট্রিও এর বাইরে না। এখানে চাইলে আপনি পয়সার বিনিময়ে ফোন সেক্স করতে পারেন। পারেন সেক্সটিং করতে। ক্লাস অ্যান্ড কোয়ালিটির কারবার সব। পাউন্ড হাতের ময়লা।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। ধরেন, ওনার নাম লিন্ডা। জাপানি মা। ব্রিটিশ বাবা। উনার মূল পেশা যৌনতা বিক্রি। লিন্ডা লন্ডনে থাকেন না। লন্ডনের কাছে উনার নিজের বাড়ি। ১৬ বছর বয়স থেকে উনি এই পেশায়। এখন বয়স ২৯। উনি একটু এক্সপেনসিভ। কারণ উনি শুধু ‘আউটকল সার্ভিস’ অ্যাটেন্ড করেন। ঘণ্টায় আপনাকে শুধুমাত্র স্বাভাবিক ‘শিক্ষামূলক’ কাজের জন্য উনাকে দিতে হবে ১৫০ পাউন্ড।

এতো গেলো স্বাভাবিক। অস্বাভাবিকটা কী?

আপনাকে লিন্ডা খুব মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করবেন- ডু ইউ ফেন্সি অ্যানিথিং?

মানে?

মানে, আপনি চাইলে লিন্ডা আপনার সাথে এয়ার হোস্টেজ সেজে ‘শিক্ষামূলক’ কাজে অংশগ্রহণ করবেন । চাইলে স্টেপ মম। চাইলে টিনেজ লাভার। চাইলে সেলস গার্ল। আপনি উনাকে যেভাবে চান, সেভাবেই উনি সার্ভিস দিবেন। এই যেমন, ‘যেমন খুশি তেমন সাজবো’ প্যাকেজের একদাম ৫০০ পাউন্ড।

এ তো দিলাম বাস্তবসম্মত উদাহরণ। এবার দিবো কিছু নগদ জ্ঞান। ব্রিটেনে পতিতাবৃত্তি ‘হালাল চিকেনের মতোই হালাল’। শুধু নর্দান আয়ারল্যান্ডে ইহা হারাম।

তবে এই হালাল-হারাম বিষয়টা বেশ ধূসর। আই মিন গ্রে। আপনি যৌনকর্মী হতে পারবেন। ১৮ বছর বয়স হতে যৌনতার বিনিময়ে পয়সা নিতে পারবেন। কিন্তু কোনও পতিতালয় বা ব্রোথেল চালাতে, বা কোনও পতিতালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারবেন না। কি বুঝলেন? আমিও আপনার মতো প্রথমে বুঝি নাই।

আসেন আবার চেষ্টা করি।

ধরেন একজন নারী, পুরুষ কিংব ট্রান্সজেন্ডারের কেউ বাসা ভাড়া নিলেন। উনি সেখানে একাই থাকেন। একাই যৌনতা বিক্রি-বাট্টা করেন। নিজের দেহ, নিজের আয়। এটা আইনের চোখে ঠিক আছে। উনার ব্যবসা ভালো। তা দেখে আপনারও ইচ্ছা হলো। চাইলেন সেই বিজনেসে জয়েন করতে। করলেনও।

করছেন কি? সর্বনাশ! আপনি তো একটা সাধারণ বাসাকে পতিতালয় বানিয়ে ফেলেছেন দাদা অর দিদি। এটা গ্রেট ব্রিটেনে নিষেধ। আর নর্দান আয়ারল্যান্ডে তো কথাই নাই।

মানে একের অধিক ‘শিক্ষামূলককর্মী’ হলেই তাহা ব্রোথেল। ধরা পড়লে মানি লন্ডারিং আর ‘পোকা’ ( প্রোসিড অফ ক্রাইম অ্যাক্টে), বিবিধ আইনে জেল জরিমানা।

এখানেই শেষ না। রাস্তা-ঘাটে কাউকে যদি ‘আমি বাজারের ছেলে/ মেয়ে, তুমি কি আমার সাথে মজা করতে চাও’ এটা জিজ্ঞেস করলেন।  সোজা ইংরাজিতে পাবলিকালি সলিসিটিং করলেন। মানে আপনি অপরাধ করলেন। পোলিস ধরতে পারলে..

কিংবা গাড়ি নিয়ে ঘুরছেন আর কাউকে বলছেন- ‘‘আনন্দ আছে। করবে নাকি আনন্দ?’” তার মানে আপনি একজন ‘ক্রাব কাউলার’। এটা করা অপরাধ। পিম্পিং বা পেন্ডারিং, মানে দালালী করা অপরাধ।

যৌনকর্মের প্রকিউরমেন্টের সাথে জড়িত থাকা ক্রাইম। জেনে না জেনে পতিতালয় মানে ব্রোথেল চালানো বা মালিক হওয়া অপরাধ। টেলিফোন বুথে বিজ্ঞাপন দেওয়া অপরাধ। ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দেয়াতেও কিন্তু  বিধিনিষেধ নেই।

তবে এখানেই শেষ নয়। যার সাথে ‘শিক্ষামূলক’ কাজে অংশ নিচ্ছেন সে কে? উনি কি চোরাচালানের শিকার? স্বেছায় এই শিক্ষা দিচ্ছেন? জোর করছে না তো কেউ? যদি এর কোনটা হয়ে থাকে, তবে আপনি ‘শিক্ষা’ কেনার দায়ে জেলে যাবেন। এটাও অপরাধ। কি, ভয় পাচ্ছেন? আপাতত আমার লেখাপড়া ছাড়া আর বাকি সবই অপরাধ।

বস! আরে বস! লন্ডনে এটা কোন ঘটনা না। চিকেন অ্যান্ড চিপস। এই ব্যবসা এখানে চলে আসতেছে সেই রোমান সময় থেকে। টেমস নদীর পাড়ে তখন এক ধরনের বিশেষ মুদ্রার ছড়াছড়ি। নাম ‘স্পিন্টরিয়া’। পণ্ডিতদের দাবি এই কয়েন আসলে যৌনপল্লীতে প্রবেশের টিকেট।

শুধুমাত্র যৌনসেবা  কেনার জন্যই সেই আমলে আলাদা মুদ্রার ব্যবসা ছিলো! বলে রাখি, তখন কিন্তু পুরুষ পতিতদের বাজার ছিলো বেশ রমরমা। এরপর টেমসে বয়ে গেছে কতো নৌকা আর জল!

লন্ডনের সেক্স মার্কেটও বেড়ে চলেছে কলেবরে। জরিপে দেখা গেছে ১৮৮৮ সালে গোটা ইংল্যান্ড আর ওয়েলসে যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিলো ২৪ হাজার ৩১১ জন।  সেখানে শুধু লন্ডনেই ছিলো ৫ হাজার ৬৭৮ জন। এর মধ্যে কতোজন পুরুষ ছিলেন? জানতে চাহিয়া লজ্জা দিবেন না। কারণ আমি জানি না।

গোটা ইউকেতেই এই ব্যবসা বেশ ডায়নামিক। সামারে বাড়ে। শীতে কমে। গ্রীষ্মকালে মানে গরমকালে সাগর পারের শহরগুলোতে প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৩০টি করে অস্থায়ী ‘শিক্ষামূলক’ প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। তো প্রশ্ন হলো, এতো এতো  যৌনকর্মী কোথা হতে আসেন? 

ওনারা কি ব্রিটেনের স্থায়ী বাসিন্দা নাকি গরমের অতিথি পাখি। আমার বেশকিছু মাসের গবেষণা বলছে, এদের মধ্যে একটি বড় অংশ দর্শনাথী। বিশেষ করে এশিয়ান যৌনকর্মীদের বড় একটা অংশ ভ্রমণ ভিসায় এদেশে আসেন। আসার পর তিনটি উপায়ে মূলত এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পরিচিত বা কোনও বন্ধুর মাধ্যমে। কোনও ব্রোকার এজেন্সি’র মাধ্যমে। অথবা কোনও পাওয়ারফুল গ্যাং এর মাধ্যমে।

এশিয়ান দেশ মূলত কোরিয়া, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ। এসব দেশ হতে যারা এসে যৌনকর্মীর খাতায় নাম লেখান, তারা বেশিরভাগই স্বাভাবিকের চেয়ে একটু এক্সপেনসিভ ।

একটু কিংবা ভালো রকম এক্সপেনসিভ। তবে ইস্টার্ন ইউরোপিয়ান দেশ রুমানিয়া, লিথুনিয়া হতে আসে লন্ডনের সেক্স মাকের্টেও সবচেয়ে বড় সাপ্লাই।

তো এর ম্যানেজম্যান্ট কেমন? আসেন একটু বিস্তারিত বোঝাই।

স্বাধীন যৌনকর্মী

উনারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। নিজেরাই ‘কল সেন্টার’ সামলান। নিজেরাই ‘আফটার কল’ সার্ভিস দেন। মানে জুতা সেলাই টু চণ্ডি পাঠ নিজেরাই করেন। স্বাধীন যৌনকর্মীরা তাদের খদ্দেরদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাই অনেক যৌনকর্মী এজেন্সির সাথে কাজ করার পরও দাবি করেন যে তিনি স্বাধীন।

এজেন্সি’র যৌনকর্মী

কিছু ওয়েবসাইট বেইজড এজেন্সি। কিছু অফিস বেইজড। এভাবেই চলে এজেন্সি। অফিস মূলত ভার্চুয়াল বা মোবাইল ফোন বেইজড। উনারা এলাকা মেনে চলেন। কখনো গ্যাংদের  কাছ থেকে নিরাপত্তা কেনেন। কখনওবা নিজেরাই একটা গ্যাং।

গ্যাং বেইজড

ধরেন, একটা এলাকায় কিছু স্বাধীন যৌনকর্মী আছে। তারা গ্যাং এর কাছ থেকে নিরাপত্তা পান। কিংবা ভয়ংকর কোনও গ্যাং মেয়েদের দিয়ে এই ব্যবসা করায়।

এর বাইরে আছে ম্যাসাজ পার্লার আর সোহো। সোহো সবার কাছে ‘সুরসুরি’র জন্য বিখ্যাত হলেও আমার কাছে বিখ্যাত জন স্নো- এর হ্যান্ড পাম্পের (এক ধরনের টিউব ওয়েলের) জন্য।

এবার জিজ্ঞেস করেন, উনি কে? উনি মর্ডান এপিডেমিলোজির জনক। উনিই প্রথম আবিষ্কার করেন, যে কলেরা পানিবাহিত রোগ। মানুষের শরীরে পর্যাপ্ত চেতনানাশক প্রয়োগের তরিকাও উনার আবিষ্কার।

এর মধ্যেই আপনার হাজারের বেশি শব্দ পড়া শেষ। কিন্তু এখনও আমি মূল প্রসঙ্গে আসিনি।

সেক্স বাঙালি সমাজে একটা ট্যাবু। না নায়িকা ট্যাবু না। মানে আছে ঠিকই! কিন্তু ঠিক কই যেন! মানে আবার নাই! কিন্তু আপনার দেশ বা সমাজে না থাকলেও লন্ডনে কিন্তু ঠিকই বাঙালি যৌনকর্মী আছেন।

মানতে কষ্ট হচ্ছে?

ঠিক আছে কষ্টটা একটু কমাই। যুক্তি বাড়াই। লন্ডনে বাঙালি এবং বাংলাদেশের মানুষের উত্তরাধিকার আছে। তাই অনেকেই বুঝে বা না বুঝে হয়তো বা সেই উত্তরাধিকারের গরমে লন্ডনে আসেন।

গ্রেট ব্রিটেনের গোটা অভিবাসন প্রক্রিয়াই যথেষ্ট জটিল এবং তা ক্রমেই জটিলতর হচ্ছে। এই কঠিন অবস্থার শিকার হয়ে অনেকেই আটকে আছেন এই দেশে।

স্ট্যাটাস অবৈধ নাগরিক। কাজ করছেন ক্যাশ ইন হ্যান্ড। তাও লুকিয়ে। ধরা পড়লেই বিপদ। এই রকম অবৈধ অভিবাসীদের সংখ্যা লাখ লাখ। এমনই একজন ‘বেনীআসহকলা’ (ছদ্মনাম)। এমন নাম বলছি কারণ, যে নামই লিখবো হয়তো সেই নামের কারও সাথে এই ঘটনা মিলে যাবে।

‘বেনীআসহকলা’ মা আর ছোট বোনকে নিয়ে ব্রিটেনে এসেছেন। যথা নিয়মে বয়স কমিয়েছেন। মা আর বোনের ভিসার মেয়াদ বেড়ে তারা এখন ব্রিটিশ সিটিজেন হবার পথে। কিন্তু উনার বাড়েনি। পড়ালেখা করেননি।

প্রায় ১১ বছরের বেশি এদেশে আছেন কিন্তু ইংরেজি জানেন না। রেস্টুরেন্টে কাজ করতে গিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিলেন। মানবিক কারণ দেখিয়ে বেনীআসহকলা- এর উকিল উনাকে পুলিশের হাত থেকে বের করে এনেছেন। এখনও উনি নগদ টাকার বিনিময়ে কাজ করেন। যেখানে কাজ করেন সেখানেই থাকেন। উনার আদৌ কি কখনও পরিবার হবে?  ব্রিটেনের কেউ কি উনাকে বিয়ে করবেন? নাহ, করবেন না।

কারণ উনি অবৈধ নাগরিক। তো  আপনি বাসা না বানিয়ে দিলে কি, মুরগী আণ্ডা দিবে না? দিবে।

এরকম অবৈধ নাগরিকদের একটা বড় অংশ হলেন এই বাঙালি যৌনকর্মীদের সেবাগ্রহীতা। উনাদের ডিসপজিবেল ইনকাম যথেষ্ট। অবৈধ নাগরিকরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে গ্রেট ব্রিটেনে একটা ইনফরমাল ইকোনমি গড়ে তুলেছেন।

মার্কেটটা কতো বড়, সঠিক কোনও গবেষণা না থাকায় বলতে পারছিনা। তবে ধারণা করতে পারি এটা বড়। পূর্ব-লন্ডনে  এমন অনেক দোকান আছে যারা নির্দিষ্ট কাস্টোমার ছাড়া কোনও রকম বেচা-বিক্রি করেন না।

এখানে এক ধরনের বিনিময় প্রথাও চালু আছে। যস্মিন দেশে যদাচার, কাঁছা খুলে নদী পার।

এতো গেলো কারা কেনে তাদের কথা। এবার বলছি যারা বিক্রি করে, তাদের কথা।

এখানে আপনি চাইলেই পারবেন! ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে।

সাংবাদিকতার প্রয়োজনে আমি নিজেও একটা এজেন্সির সাথে কথা বলেছিলাম। আপনি তাদের এককালীন একটা টাকা দিলে ওরা আপনার জন্য কাস্টোমার খুঁজে দেবে। চাইলে আপনি নিজেও বিশেষ কিছু ওয়েবসাইটে নিজের বিজ্ঞাপন নিজেই করতে পারেন। এটা ফ্রি।

কতোজন নারীর কথা বলবো? সবার কথা এখানে বলা যাবে না। কারণ আপনার সময় আমার চেয়ে বেশি মূল্যবান। আরেকটা কথা, এই যাত্রায় শুধু বাঙালি নারী যৌনকর্মীদের নিয়ে লিখছি। এখানে বাঙালি পুরুষ যৌনকর্মীও আছেন। তাদের নিয়ে আরও বিস্তারিত জেনে তারপর লিখবো।

নাম ‘আসহকলাবেনী‘। বাড়ি বাংলাদেশ। কোন জেলায় তা নির্দিষ্ট করে বলতে চাই না। স্বামী বিয়ে করে এদেশে নিয়ে এসেছেন। লিগ্যাল স্ট্যাটাস ঠিকঠাক। ভালোই কেটে যাচ্ছিলো দিনকাল। ঝামেলা করলেন স্বামী। নৈতিকতার মান এবং দণ্ড কোনটাই ঠিক রাখতে পারলেন না।

‘আসহকলাবেনী’ আপত্তি করতেই তিন সন্তানসহ ডির্ভোস। ভাষা জানা নেই ঠিকঠাক। শিক্ষাও নেই তেমন। বিশ্বাসী মানুষ এক বান্ধবীর স্বামী। সেই ভদ্রলোক লুকিয়ে লুকিয়ে বেশ কিছুদিন ‘আসহকলাবেনী’কে সাহায্য করলেন।

এর মাঝে কাউন্সিল একটা ফ্ল্যাট দিলো। সাথে দিলো বাচ্চাদের এডুকেশন আর মাথা গুণে কিছু টাকা। কাঁচামরিচের কেজি কি শুধু বাংলাদেশে দু শ টাকা? লন্ডনে ফ্রি? নাহ্। এখানে খরচ আরও বেশি। একদিন বান্ধবীর স্বামীও নৈতিকতা ভুলে গেলেন। এতোদিনের বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত ‘আসহকলাবেনী’কে টেনে নিয়ে গেলো অন্য পথে।

প্রথমে শুধু বান্ধবীর স্বামীর মধ্যেই বিষয়টা সিমীত ছিলো। এখন বান্ধবীর স্বামীই ‘আসহকলাবেনী’র ব্রোকার। বান্ধবীর স্বামী একটা এক বেডরুমের বাসা ভাড়া করেছেন। সপ্তাহে পাঁচদিন ‘আসহকলাবেনী’ সেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকেন।

শনি, রোববার বা বিশেষ চাঁদ উঠলে সময় দেন। সাদা এবং বাদামী বর্ণের মানুষরা সাদরে আমন্ত্রিত। কালোদের ঠাঁই নাই ।

- কেন নাই ?

- বুঝে নেন (মুচকি হেসে)। ১৫ মিনিট ৫০ পাউন্ড। ৩০ মিনিট ৮০ পাউন্ড। এক ঘণ্টা ১৬০ পাউন্ড।

- এই বাসা কি শুধু ‘আসহকলাবেনী’ একাই ব্যবহার করেন? নাকি এটা একটা ব্রোথেল? এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি।

এখন বলছি গ্রেট ব্রিটেনে জন্ম এমন একজন বাঙালি মেয়ের কথা। নাম- তিরিং (ছদ্মনাম)। বয়স ১৮ এর কিছু বেশি। পরিবারসহ থাকেন ম্যানচেস্টারে। সেখান থেকে কাজের কথা বলে লন্ডনে এসেছেন। সাথে আছেন একজন পাকিস্তানি বান্ধবী। উনার নাম বিরিং (ছদ্মনাম)।

দু’জন একটা দুই বেডরুমের বাসা নিয়ে থাকেন। লোকাল গ্যাং উনাদের সাহায্য করেন। ১২ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। বোরখা পরেন। খুবই স্মার্ট। উনার জন্য টাকা আয়ের এটা একটা সহজ রাস্তা। কিছু টাকা জমিয়ে হয় কোনও একটা ব্যবসা করবেন। না হয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবেন। এরকমটাই বললেন।

তারপর আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- ইউ নো হোয়াট? আই রিয়েলি ডোন্ট নো হোয়াট অ্যান্ড হোয়ার অ্যাম আপ টু। নাউ প্লিজ ডোন্ট ওয়েস্ট মাই টাইম। ইটস ফাকিং উইড টাইম।

- তুমি কি জানো, তুমি একটা ব্রোথেল চালাচ্ছো? এটা যে অবৈধ জানো?

- ইজ ইট? আই ডোন্ট কেয়ার অর হোয়াট ইফ উই হ্যাভ আওয়ার ওউন ব্যাকআপ। ওউন্ট টেল ইউ ( জোরে হেসে)।

বয়সের কারণেই বেশ উচ্ছ্বল ‘তিরিং’। ‘বিরিং’ খুব একটা কথা বলেন নাই। দু’জনই প্রায় বারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা কাজ করেন। শনি, রোববারে এটা গিয়ে কখনো কখনো ঠেকে ২০ ঘণ্টায়।

এতো গেলো স্বাধীন বাঙালি নারী যৌনকর্মীদের কথা। এবার বলছি একটা চক্রের কথা। লন্ডনে বাদামী রঙের যৌনকর্মীদের চাহিদা বেশ। দামও চড়া। এখানে একজন আপা আছেন। উনি বেশ প্রভাব রাখেন। উনার র‌্যাকেটে বেশকিছু বিবাহিত নারী এবং লন্ডনে পড়তে আসা স্টুডেন্ট আছেন। অনেকটা ক্যাজুয়াল সেক্সের আড়ালে উনি উনার ব্যবসা চালান। বিষয়টা সরাসরি যৌনতা বিক্রি নয়। পুরোটাই বন্ধুতায় শুরু। বেশ কয়েক বছর আগে  একজন বাঙালি যুবক লুকিয়ে এই র‌্যাকেটের একজন সদস্যকে ভিডিও করেছিলেন।

এই র‌্যাকেট তো বটেই বাঙালি যৌনকর্মী সবাই বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করেন। কখনোই সঠিক ঠিকানা ওনারা দেন না। ধরেন, আপনাকে একটা পোস্ট কোড দেওয়া হলো ঊ১৪ ৩ঢঢ । আপনি সেখানে পৌঁছে ফোন করলেন। তারপর আপনাকে কেউ একজন ফলো করবেন। প্রতিবারই ঘনঘন ফোন কেটে দেওয়া হবে। যাতে করে আপনি বারবার ফোন করেন। আপনি  বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করলেন।

বাসায় ঢোকার অনুমতি মিলবে। বাসার বাইরে ক্যামেরার সামনে কিছুক্ষণ স্ক্রিন টেস্ট দিতে হবে। তারপর মিলবে ঘরে ঢোকার অনুমতি।

বিখ্যাত সেই আপা গ্যাং এর একজন যৌনকর্মীকে অনেক কষ্টে আমি ইন্টারভিউ এর জন্য রাজি করাই। উনার বাসায় যেতেও আমাকে একই প্রসেস ফলো করতে হয়েছে। উনাকে ‘ইমপ্রেস’ করতে একটা ছোট্ট গিফট নিয়ে গিয়েছিলাম।

উনার নাম ধরেন, নামিকা। বয়স নিয়ে উনি সবাইকে মিথ্যা বলেন। আমাকে সত্য বলছেন দাবি করে জানালেন- উনার বয়স ৩৭।

- আমি বাঙালি। কিন্তু বাংলাদেশের না। (অথচ কথায় স্পষ্ট বাংলাদেশের একটা জেলার টান।)

- কতোদিন ধরে এই পেশায়?

- এই তো অনেক বছর।

- আয় কেমন?

- ভালো।

- এই বাড়িতে আর কেউ আছেন?

- আসো দেখো। (সব দরজা খুলে দিলেন। কেউ নেই।)

- আপনার আপা কেমন আছেন?

- উনি ভালো। কবিতা লেখেন মাঝে মাঝে। উনি ভালো থাকেন বলেই আমরা ভালো আছি।

- দেশে যান?

- নাহ।

- ইচ্ছা হয় না?

- হয়, পেপার নাই। আর কার কাছে যাবো? কেউ তো নাই আর সেখানে।

আমাদের অনেক কথা হয়। এই কথার মাঝেই একটা ফোন আসে। ফোনের ওপাশে একটা মেয়ের কণ্ঠ। জোরে কাশির শব্দ। ‘নামিকা’ উনার মেয়েকে তার আরেক মেয়ের জন্য ফোনে ফোনে ওষুধ বলে দেন।

আমাদের দু’জনের মধ্যে এরপর নীরবতা নেমে আসে। আমার মুখ থেকে আর শব্দ বের হয় না। আমি উঠে আসি। দরজার সামনে আসতেই ..

নামিকা বলেন- এই যে আপনি এই প্যাকেটটা ভুলে গেছেন!

- এটা আপনার জন্য। গিফট। শুধু কথার জন্য টাকা তো নিবেন না তাই।

নামিকা চুপ। মনে হলো ওনার চোখে কি যেন পরলো। 

-রাখেন। আপনার মেয়েদের দিয়েন না হয়।

নামিকা: নাহ। আমিই রাখি, কেউ তো গিফট-টিফট দেয় না খুব একটা আমারে।

আমি আর পেছনে তাকাই না। বের হয়ে যাই। বের হয়ে জনি ভাইকে একটা ফোন করি।

- জনি ভাই, প্লিজ, কোনভাবেই যাতেই নামিকার চেহারাটা বোঝা না যায়।

আমি এখনও ভাবছি..আসলেই কি স্টোরিটা আপনাদের জানা খুব প্রয়োজন। জেনে কিই বা করবেন? আপনাদের দেশে সামান্য ফেইসবুক স্ট্যাটাসের আগুনে শ’য়ে শ’য়ে হিন্দুদের বাড়ি পুড়ে যায়।

কী করেন তখন আপনারা, আমি কিংবা আমরা? সত্যিকারের আগুন নেভাতে ফেইসবুকে পানি ঢালি। আমার মতো অনলাইনে লিখি। কলম দিয়ে আমরা আর মানুষের চোখের জল মুছতে পারছি না। আমি, আপনি কেউ না। আমরা অর্থব হয়ে গেছি! 

লেখক: গবেষণা আর লেখালেখির চেষ্টা করেন । 

ছবি: যৌনকর্মীরা স্বয়ং এবং রয়টার্স।

ই-মেইল: kurchiphool@gmail.com

রিনভী তুষারের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!