চুপিচুপি দেশে এসে...

যুক্তরাষ্ট্র,অস্ট্রেলিয়া,যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ এবং এশিয়ার অনেক দেশেই পড়ালেখা করছেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। কেউ পড়ালেখা করছেন সরকারি এবং বেসরকারি বৃত্তিতে আর অনেককেই পকেট থেকে দিতে হচ্ছে টিউশিন ফি।

শারমিন জান্নাত ভুট্টো, যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2017, 11:19 AM
Updated : 14 Sept 2017, 01:41 PM

বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই একটা মোটা অংকের টিউশিন ফি দিয়ে দেশের বাইরে পড়তে আসেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাধ ও সাধ্যের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি হওয়াতেই অনেক শিক্ষার্থী তাদের স্বপ্ন পূরণে পাড়ি দেয় ভিন দেশে। তারপর ধীরে ধীরে পরিচিত হতে থাকে ভিন দেশের সমাজ,সংস্কৃতি আর আচার-ব্যবহারের সাথে।

ছবি: শাফি নেওয়াজ

সে রকম চেষ্টায় এখনও রত আছি আমি। মাঝে-মধ্যে পড়ালেখা, কফি শপের কাজ আর নিজের জীবনের সুর একই তালে বাঁধতে গিয়ে কখনো কখনো হাঁপিয়ে উঠি। তবুও জীবন থেমে থাকার নয়, এ মন্ত্রকে কাঁধে নিয়ে একটু একটু এগোনোর চেষ্টা। গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি সেটি হচ্ছে- দেশে ফিরবো কবে?

ছবি: শারমিন জান্নাত ভুট্টো

মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রতিমাসে অন্তত একবারের জন্য হলেও আমি দেশে ঘুরে আসি যা কেউই এখন পর্যন্ত জানে না। অনেকটা চুপিসারেই কাজটা সেরে ফেলি। যেহেতু দেশে গেলে সবার জন্য কিছু না কিছু উপহার না নিলেই হয় না, তাই অল্প অল্প করে একটা একটা করে উপহার নিজের সামান্য আয় থেকে কিনতে থাকি।

ছবি: আনোয়ার জাহিদ

আর যেগুলো কিনতে পারি না সেগুলোতে কেবল চোখ বুলিয়ে আসি। যাতে করে পরেরবার টাকা জমিয়ে তা ঠিকই কিনে নিতে পারি। অন্যান্য দেশে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম জবের বিষয়ে ঢালাও ভাবে না জানলেও, যুক্তরাজ্যের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে একটু হলেও বলতে পারি। এখানে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ ২০ ঘণ্টা কাজ করতে পারে।

আর টার্ম ব্রেকে সর্বোচ্চ ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি আর জুন থেকে অগাস্ট এই ছয়মাসে শিক্ষার্থীরা ফুলটাইম কাজ করতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স ভেদে টার্মব্রেক একেকটি ক্ষেত্রে একেক রকমের হয়।

ছবি: আনোয়ার জাহিদ

অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতন আমিও আমার টার্মব্রেকে ফুলটাইম কাজ করি এই ভেবে যদি কিছু বাড়তি অর্থ কামিয়ে নেয়া যায় ওই সময়টাতে। আর সেটা দিয়েই হয়তো পাড়ি জমানো যাবে দেশে।

যেই ভাবনা সেই কাজ। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি টানা তিনমাস কাজ করে জমা করা হলো কিছু বাড়তি অর্থ। উদ্দেশ্য ও গন্তব্য শুধুই ঢাকা। টাকার পেছনে ছুটে শেষ মুহূর্তে যখন টিকেট কাটতে গেলাম তখন দেখি তার দাম আকাশচুম্বী!

বিমানের টিকেট খরচ (আনুমানিক), কেনাকাটা (উপহার) আর দেশে হাত-খরচ বাবদ যে টাকা জমানো হয়েছে তাতে অন্তত এইবারের মতো যাওয়া হচ্ছে না ওই পিকটাইমে কিংবা বলা যেতে পারে শেষ সময়ে এসে টিকেটের দাম দেখে।

ছবি: শারমিন জান্নাত ভুট্টো

কোনও উপায়ন্তর না দেখে ভাবলাম পরের টার্মব্রেকে নিশ্চয় যাওয়া হবে। আর পরের টার্মব্রেকে মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে আসন্ন ভিসা বাড়ানোর ঝুক্কি নয়তো বকেয়া টিউশিন ফি শোধ করার তাড়া নয়তোবা পরের কোর্সের জন্য টিউশন ফি জমানোর তাগিদ। আর এভাবেই জীবনটা গত পাঁচ বছর ধরে চক্রাকারে ঘুরেই যাচ্ছে।

ছুটিরদিনগুলোতে ইউরোপের কোনো দেশে গিয়ে ১৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ডে সব খরচ সারতে পারলেও নিজ দেশে যেতে হলে ওই অংকের সাথে আরেকটি শূন্য যোগ করতে হবে। অর্থাৎ দেড় থেকে তিন হাজার পাউন্ড পকেটে না থাকলে দেশ থেকে ঘুরে আসার চিন্তাই করা যায় না। 

আর এ কারণেই হয়তো কোনও মাসে বাসার পুরনো ছবি, কিনে রাখা সেই উপহার কিংবা চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক চলে যাওয়া উৎসব দেখে যখন মন ও শরীর ক্লান্ত হয়ে এলিয়ে পড়ে বিছানায়- তখনই কোনও এক স্বপ্নের ঘোরে ঘুরে আসি প্রিয় দেশ থেকে; যার পুরোটাই অজানা থেকে যায় সবার কাছে।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও নিউজ প্রেজেন্টার

ই-মেইল: Sharminbhutto@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!