জাপানের চিঠি: স্যালুট মানবিক বাংলাদেশ

সোমবার সকালে ল্যাবে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশ করা কিছু ছবি দেখছিলাম, তখন আমার ডেস্কের পাশে বসা আমার জাপানি সহপাঠি আমার ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ ফেলাতেই জিজ্ঞাসা করলো, কী ব্যপার নাদিম তোমার দেশে কি টাইফুন হয়েছে? নাকি হ্যারিকেন?

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2017, 08:56 AM
Updated : 12 Sept 2017, 09:06 AM

আমি ওর কথা শোনার পর তার কাছে জানতে চাইলাম, তোমার ধারনা কি? কী কারণে মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছো? সে এবার উত্তর দিলো, আমার ধারনা তোমার দেশে বড় ধরনের দুর্যোগ হয়েছে, তার জন্য হয়তো তারা উদ্বাস্তু হয়েছে।

আমি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ থেকে ওকে বললাম, রোহিঙ্গাদের নাম শুনেছো? মিয়ানমারের নাম শুনেছো? এইবার সে বললো, হ্যাঁ মিয়ানমারের নাম শুনেছি। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক কী?

রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ওকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর, ওর মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। সে আমাকে বললো, রোহিঙ্গা কি মানুষ নয়? ওদেরকে কীভাবে একটি দেশ দশকের পর দশক ‘ভিন্ন জগতের’ মানুষ হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছে?

ধর্মীয় সংঘাতের বিষয়টি যখন ও বুঝতে পারলো, তখন সে আমাকে বললো, কোন জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে আইসোলেট করে কিসের ধর্ম হয় শুনি?

তোমরা এতোগুলো মানুষকে বাংলাদেশে ঠাঁই দিচ্ছো জেনে খুব খুশি হয়েছি। স্যালুট বাংলাদেশ! স্যালুট মানবতা!

সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি জানতে পারলাম, তা হলো- জাপানের অধিকাংশ গণমাধ্যমই সংবাদ করছে না। এনএইচকে ওয়াল্ড সার্ভিস নিউজ উঠালেও জাপানি ভাষার সাইটে নিউজ হচ্ছে না।

আমার আরেক সহকর্মী যার নাম ইনাগাকি বিষয়টি জানার পর আমার কাছে এসে বিষয়টি জানতে চাইলো। আমি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে মোস্তাফিজ মামুন ভাইয়ের ছবিগুলো দেখানোর পর ওর চোখের কোণে জল দেখতে পেলাম।

সে বললো, অনলাইনে আমার কয়েকজন বন্ধু অং সান সুচির নোবেল কেড়ে নেওয়ার জন্য মতামত দিয়ে স্বাক্ষর দিয়েছে। তবে কী কারণে দিচ্ছে তা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম।

মিয়ানমারকে আমরা তো ভাল দেশই ভাবতাম। কিন্তু তারা কীভাবে এই ধরনের বর্বর কাজটি করতে পারে! ইটস রিয়্যালি টেরিবল!

তার মতে, জাপান সরকারকেও মিয়ানমারের উপর চাপ দেওয়ার পরামর্শ আসে।

আমার কাছে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র পেয়ে সে খুব উৎসাহী হয়ে উঠলো। তার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি জাপানিদের কাছে তুলে ধরা উচিত।

এই গেল আমার ল্যাবের অবস্থা। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মিয়ানমারের চিত্র উঠার পর আমার ইন্দোনেশিয়ান, মালয়েশিয়ার সহপাঠিদের মনে ক্ষোভের দানা বেঁধেছে। যখন কোথাও দেখা হচ্ছে তাদের সঙ্গে, তখন তারা বলছে, অনলি বাংলাদেশ ইজ সোয়িং রিয়াল হিউম্যানিটি। ইউ গাইস ব্রাভো, গ্রেট হার্টেট।

কথাগুলো শোনার পর মনের ভেতর এক ধরনের অনুভূতি কাজ করছে। পৃথিবীর এতো বাঘা বাঘা দেশ যেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে না সেখানে বাংলাদেশ যে মহত্বের পরিচয় দিয়েছে তা আমরা প্রবাসে বসে ভিন দেশিদের কাছ থেকে শুনছি।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব মতে, সারা বিশ্বে ২১ কোটি ৩ লাখ ৮৮ হাজার ২৯ জন শরণার্থীদের মধ্যে ইউরোপে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৩ জন, অস্ট্রেলিয়াতে ৩৬ হাজার ৯১৭, বেলজিয়ামে ৩৫ হাজার ৩১৪, জাপানে ২ হাজার ৪৭৪, ভারতে ২ লাখ ১ হাজার ৩৮১, যুক্তরাজ্যে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৭, যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ৭৩ হাজার ২০২ ও বাংলাদেশে ২ লাখ ৩১ হাজার ৯৫৮ জন রোহিঙ্গা রয়েছে।

তবে সর্বশেষ হিসেবটি যদি যোগ করা যায় তাহলে বাংলাদেশ শরণার্থী সংখা প্রায় ছয় লাখ ছাড়িয়ে যাবে। নিঃসন্দেহে সেটি যে কোন দেশের চেয়ে সবচেয়ে বড় সংখ্যা। যে দেশের মানুষই নানা সংকটে দিন পার করছে সেই দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেখভাল করা যে কোন রাষ্ট্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।

অথচ বাংলাদেশ সাহসী ভূমিকায় সবার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এই ছোট রাষ্ট্রের মনুষ্যত্ব দেখে অনেক নামি-দামি রাষ্ট্র চোখ উপরে তুলেছে, কিন্তু দিন শেষে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি প্রশান্তির বাতাস বয়ে দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে আসার দৃষ্টান্ত কেবল স্বচ্ছল রাষ্ট্রের জন্য নয় দাতা দেশগুলোও না না করে মুখে ফেনা তুলে দিতো। তাই অভিনন্দন বাংলাদেশেরই প্রাপ্য।

মানবিকতা কিংবা আবেগের প্রক্ষেপণে আমরা আজ রোহিঙ্গাদের অতিথি করেছি। গত কয়েক দশক ধরেই আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে রয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নয় জাতিগত কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিতে এই দেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতশীল। যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা দেখে চোখের কোণে দুই ফোঁটা পানি জমাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই আমরাও আবেগ প্রবণতার রেখায় দাঁড়িয়ে সমগীত গাচ্ছি।

কিন্তু আমাদের আবেগকে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠী যে জাতীয় ও আন্তজার্তিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে তা থেকে বাংলাদেশ কি মুক্তি পাবে? আমাদের শঙ্কার জায়গা সেখানেই, মাছের মায়ের কান্না শুনে যদি আমরা আমাদের ‘মা’ কে ভুলে যাই তাহলে আমাদের বোধশক্তির ভঙ্গুরতায় প্রকাশ পাবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে পূর্ব-পশ্চিয়ে যে হরি খেলা শুরু হয়েছে সেই বিষয়টা ভাবতে গেলে শরীরে এক ধরনের শিহরণ শুরু হচ্ছে, যা বলবার নয়।

আমার ভয়ের কারণ হলো, তুরস্ক। যে দেশটি নিজেরাই উগ্রপন্থি ইসলামিক স্টেট বা আইএসকে লালন-পালন করার অভিযোগ সারা বিশ্বে জোরালো সেই দেশটি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সরগরম সত্যিই ভয়ানক ব্যপার-স্যাপার। যে দেশটি গেল বছর মে মাসে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চোখ রাঙানি দিয়ে তাদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যহার করে নিলো, সেই দেশের রাষ্ট্র প্রধানের স্ত্রী রোহিঙ্গাদের জন্য উড়ে এসে দু’ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে আমাদের বাঙালিদের আবেগকে শাণিত করে গিয়েছে। এই আবেগ যে কতটা ভয়ানক হতে পারে তা সময়ই বলে দেবে।

গত কয়েক বছর ধরেই থেমে থেমে রোহিঙ্গাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে মিয়ানমার। আর এই আক্রমণে অনেক রোহিঙ্গায় হয়েছে পিতৃহারা, কেউ বা হয়েছে সন্তানহারা। আর এই ক্ষোভে জাতীয়তাবাদের রশি ধরে উগ্রপন্থি দলও তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। আমাদের শঙ্কার জায়গা হলো এটা। আজ বাংলাদেশ তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে। ধরুন, কতিপয় উগ্রবাদীরা ক্ষোভের বশবতি কিংবা আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর দাবার চালে মিয়ানমারে সহিংসতা চালালো। আর মিয়ানমার সেই ছুঁতোতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দোষারোপ শুরু করলো। আর এই অজুহাতে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত শরণার্থী শিবিরগুলোতে যদি অভিযান চালায় সেই পরিস্থিতি কে সামাল দেবে?

আবার ধরুন, রোহিঙ্গাদের আমরা কিছুদিন আশ্রয় দিলাম, ধরুন কয়েক বছর দিলাম। এরপর কোন এক সময়ে যদি রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার কথা উঠে তারা কি বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে? যদি না যায়, সেই সময় তারা যদি বিক্ষোভ সহিংসতা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি তোলে তাহলে সেটা সরকার কীভাবে সামাল দেবে? এমনি তো নাচনি বুড়ি তার উপর ঢাকের বাড়ি।

রোহিঙ্গাদের পুষে রাজনীতি করার খায়েস কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের দীর্ঘদিনের শখ। তাই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বরাবরই তারা হাত বাড়িয়ে নিজেদের পাল্লাকে ভারি করে। এই ইস্যু নিয়ে তারাও যে সরগরম হবে না কোন নিশ্চয়তা আছে কি?

জাতিগত নয় বরং ধর্মীয় আবেগের পাল্লা আমরা রোহিঙ্গাদের আপন-জ্ঞাতি ভাই মনে করছি। রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে মোড়লরা এখন উঠে পড়ে লেগেছে তাদের পুরাতন ঘরে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে। দীর্ঘ সময়ে সেনা শাসিত মিয়ানমারের সামরিক শক্তিকে বড় হিসেবে দেখলেও প্রতিবেশি ভারত কিংবা চীনের অস্তিত্বও লক্ষ্য করার মতো।

শত বছরের সমস্যা যখন নিরশনকল্পে কেউ এগিয়ে আসে না তখন ধরে নেওয়াই ভালো, মিয়ানমার মূলত বৌদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করতে এই দশ লাখ রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যূত করতে দ্বিধা করেনি। তার পেছনে যে আন্তর্জাতিক রহস্যঘেরা টোপ আছে তা নিয়ে আমরা শঙ্কা প্রকাশ করি।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আমরা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের উদারতাই প্রকাশ করেছি। কিন্তু এই বিষয়টি নিয়ে দেশি কিংবা আন্তর্জাতিক মহলে যেন ক্ষোভের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় সেটা আমাদের মতো ছোট দেশের জন্য লক্ষণীয় বিষয় বটে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যদি তৎপর হতো তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যা এভাবে বছরের পর বছর জিইয়ে থাকতো না।

ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে কিছুকাল সহানুভূতি দেখানো যায়, কিন্তু যে সম্প্রদায়ের মানুষকে জুলুম নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে সেই সম্প্রদায়ের পাশে একক কোন রাষ্ট্র নয় বিশ্বনেতাদের জোরালো ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছি। আমরা রোহিঙ্গাদের কেবল মুসলমান হিসেবে পরিচয় করে দিচ্ছি, ফলশ্রুতিতে আবেগের ঝুঁড়িটাও ভারি হয়ে উঠছে।

রোহিঙ্গারা যে মানুষ তা কি বিশ্ব ভুলে গেছে? কেন প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো সুষম চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? এর সাথে বিশ্ব রাজনীতির প্যারামিটারগুলো কী কী তা বাংলাদেশকে চিহ্নিত করে এগিয়ে যেতে হবে। সব জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানবিক কণ্ঠ সজাগ থাকুক।

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!