কোরিয়ায় বাঙালি শিক্ষার্থীদের জীবন

শোয়েব যখন পিএইচডি করার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া আসলো, তখন অনেকে খুব আগ্রহের সাথে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতো।

সাজিয়া শিলা, দক্ষিণ কোরিয়া থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Sept 2017, 04:33 AM
Updated : 9 Sept 2017, 10:27 AM

জিজ্ঞেস করতো, কোরিয়া যাচ্ছেন? কেন? অন্য কোথাও কেন যাচ্ছে না? এরকম অনেক কিছুই। তাদের জিজ্ঞেস করার ধরনটাই কেমন যেন ছিল! এরকম অনেককেই এইসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে যারা দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য এসেছে অথবা আসছে।

কিন্তু এখন আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, সত্যিই এখন সবাই খুব ভালো করে জানতে চায় যে আমরা কেমন আছি? কোরিয়া কেমন? আর যখন আমরা ইতিবাচক বলি, তখন খুব খুশি হয় এবং দেখার জন্য বেড়াতে আসতে চায়। আর নিরাপত্তার কথা শুনে, সত্যি খুব আশ্চর্য হয় যে এতোটা নিরাপত্তা কোরিয়া!

যেহেতু শোয়েব উচ্চশিক্ষার জন্য কোরিয়া এসছিলো, তাই সাধারণভাবেই ওইখানে সবাই শিক্ষার্থী ছিল। সব সময় সব কিছুতেই পড়ালেখা আর পড়ালেখা। আর আমরা প্রবাসীরা যেখানেই বাঙালি দেখি, সেখানেই খুশিতে কথা বলতে যাই। আর যদি ওইখানের সব বাঙালিরা একসঙ্গে পরিবারের মতো থাকা যায়, তাহলে তো কথাই নেই।

ঠিকই ভেবেছেন। আমরা এখানে একটা পরিবার। আর আমার কাছে বাঙালি কমিউনিটি থেকে বাঙালি পরিবার শব্দটাই বেশি প্রিয়। যেকোনো কাজ হোক না কেন, এখানে সবাই সবার জন্য। যে কোনো বিপদ হোক, আর আনন্দ হোক। তবে সবার ব্যস্ততার জন্য প্রতিদিন দেখা, কথা হয় না। কিন্তু সব সময়ের জন্য সবাই ঐক্য অনুভব করি।

শত ব্যস্ততার মাঝেও বিশেষ দিনগুলোতে সবাই একবেলা হলেও বসে খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডা চলে। এই তো, ঈদের দিনে আমার বাসায় রাতের বেলায় সব ছোট ভাই-আপুরা একসঙ্গে হয়েছিলাম ঈদের আনন্দটাকে একটু বাড়িয়ে নিতে। অসম্ভব সুন্দর সময় কাটিয়েছি আমরা সবাই মিলে। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুক, খাওয়া- সব মিলিয়ে আড্ডাটা জমেছিল বেশ। সব মিলিয়ে একটা ভরপুর ঈদের আনন্দ আমাদের জন্য।

আমরা সবাই যখন একসঙ্গে হই, তখন বড় ভাই বা আপু হিসেবে সবার খোঁজ-খবর নেওয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যে চলে আসে। সাথে তো আড্ডা-মজা এগুলো চলতেই থাকে। এখানে যারা পড়তে আসে, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেকদিন থেকে অল্প হলেও একটু ধারণা দেওয়ার চিন্তা করছিলাম। ঈদের দিনেই পেয়ে গেলাম সবাইকে একসঙ্গে। আড্ডা দিতে দিতেই সবার সঙ্গে এগুলো নিয়ে কথা হলো। আমার অভিজ্ঞতা তো আছেই, সাথে ওদের অভিজ্ঞতা আর কোরিয়ান জীবন কেমন কাটছে- সব বিষয়েই কথা হলো।

আড্ডার শুরুতেই কথা হচ্ছিলো, কেমন কাটলো ঈদ? সবার একই কথা, ঈদের দিন শুক্রবার থাকায় কোনো ছুটি ছিল না। সকালে ঈদের নামাজ পড়ে যে যার মতো ল্যাবে চলে গিয়েছে। ঈদ শুরুই হয়েছে সন্ধ্যার পর থেকে, চলবে রোববার পর্যন্ত। আর এই সেমিস্টারে নতুন যারা এসেছে, তাদের মন বেশ খারাপ ছিল। কারণ দেশের বাইরে এটাই তাদের প্রথম ঈদ, পরিবার ছাড়া। খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।

এরপর আস্তে আস্তে আড্ডাটা আরও জমতে শুরু করলো। ওদের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, উচ্চশিক্ষার জন্য কোরিয়াকে কেনো বেছে নিলেন? মোটামুটি সবার উত্তর একই। কোরিয়াতে গবেষণা অনেক অনেক বেশি ভালো। যারা সত্যিই ভালো কাজ করতে চায়, তারা কোরিয়াতে আসতে পারে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, আপনি যদি স্কলারশিপ নিয়ে এখানে পড়তে আসেন, তাহলে আপনাকে অন্যকিছু নিয়ে, মানে আপনি চলবেন কীভাবে তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।

মাস্টার্স, পিএইচডি- যেজন্যই আসুন না কেন, আপনার আসল উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে মন-প্রাণ দিয়ে কাজ করা বা গবেষণা করা। এতে করে আপনি একটা মূল বেতনও পাচ্ছেন, যার জন্য থাকা-খাওয়া, হাত খরচের জন্য আপনাকে অন্য কোথাও চাকরি করতে হচ্ছে না। এতে সুবিধা হচ্ছে, পুরো সময়টা আপনি কাজ করতে পারছেন। কাজটাও হচ্ছে আর পারিশ্রমিকটাও পাচ্ছেন। তো সব মিলিয়ে এখানে সুযোগ-সুবিধাটাও অনেক।

আর থাকা-খাওয়ার ব্যাপারটা যদি বলা হয়, তাহলে প্রথমত, শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য আবাসিক হল আছে সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ইচ্ছে হলে সেখানেও উঠতে পারেন, না হলে সবচেয়ে ভালো হয় চার-পাঁচজন বাঙালি মিলে একসঙ্গে বাসা ভাড়া করে থাকাটা। আবাসিক হলে রান্নার একটা ঝামেলা থাকে। একসঙ্গে থাকতে গেলেও রান্না করেই খেতে হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে সহযোগিতা থাকে সবার। এতে অর্থ সঞ্চয়ও হয় ভালো, আর অবসরও খুব সুন্দর কাটে। নিজেকে তখন আর একা লাগে না।

অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কোরিয়া কীভাবে আসা যায়? আপনি যদি সত্যিই কোরিয়া উচ্চশিক্ষার জন্য আসতে চান, তাহলে প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেকে গোছানো। এক, আপনাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে, এই মন-মানসিকতা আপনাকে আসার আগে থেকেই নিয়ে আসতে হবে। এরপর শুরু করতে হবে খোঁজ, যেটা মূলত আপনাকেই করতে হবে। অধ্যাপকদের ইমেইল করা, কাগজপত্র সব যোগাড় করা- সবটাই নিজের করা ভালো। এক্ষেত্র যারা কোরিয়াতে আছেন, আপনি তাদের জিজ্ঞেস করলেও অনেক সাহায্য পাবেন।

কিন্তু কাজগুলো আপনাকেই করতে হবে। উচ্চশিক্ষা, ভালো ভবিষ্যতের জন্য এটুকু আপনাকে করতেই হবে। আর একবার ভালো কাজ করতে পারলে আর ভবিষ্যতের চিন্তা নেই। যে যতো ভালো কাজ করবে, তার ভবিষ্যৎ ততো উজ্জ্বল- এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর হ্যাঁ, ছোটখাটো জটিলতা আসবেই জীবনে। তাই বলে কিছুই থেমে যায় না।

কোরিয়ায় থাকতে কেমন লাগছে?

অসম্ভব ভালো লাগছে। কোরিয়ার নিরাপত্তার কথা আমি আগেও বলেছি। এখনও জানাতে চাই যে, নিরাপত্তার দিক থেকে কোনোভাবেই আপনার চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। আপনি বিদেশি হোন আর কোরিয়ান, নিরাপত্তা সবার জন্য সমান আর নিরাপদ তো অবশ্যই। এছাড়া কোরিয়ানরা খুব পরিশ্রমী। কাজটা আপনার থেকে বের করে নেবেই ওরা। ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এসবের জন্যই কোরিয়া গবেষণার দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে।

মাস্টার্স না পিএইচডি’র জন্য কোরিয়া ভালো?

ভালো আসলে দু’টোর জন্য। একসঙ্গেও আসতে পারে। তাই এখান থেকে যারা মাস্টার্স করেছে, তাদের জন্য পৃথিবীর যেকোনো দেশে পিএইচডির সুযোগ পাওয়া বেশ সহজ। কেননা, মাস্টার্সে এই শিক্ষার্থীদের নূন্যতম দু’টো গবেষণাপত্র জার্নালে প্রকাশ করতে হয়।

কোরিয়াতে দিনকাল কেমন কাটছে?

বেশ ব্যস্ততায় দিন কাটাতে হয় সব শিক্ষার্থীদের। পড়ালেখা, ল্যাব, কনফারেন্স- সব মিলিয়ে বেশ ব্যস্ত সপ্তাহ কাটে সবার। তবে এর মধ্যে আড্ডা, খেলাধুলা চলে প্রচুর। সপ্তাহের শেষের রাতে ফুটবল খেলা, পরদিন দিনে ক্রিকেট খেলা আছেই ওদের রুটিনের মধ্যে। ওদের বিনোদন মানেই সপ্তাহের শেষে খেলাধুলায় সময় কাটানো। আর নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো।

কর্মক্ষেত্র ও ল্যাবের পরিবেশ

আগে থেকে আসলে ল্যাবের কথা কেউ বলতে পারে না। অধ্যাপক কেমন, তার ফান্ডিং কেমন- তা কেউ বলতে পারে না যদি ওই ল্যাবে কোনো বাঙালি না থাকেন। তবে বেশিরভাগই ভালো হয়। এখানে আসলে ভাগ্যটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে সব মিলিয়ে কি সব সময় সব কিছু হয়? হয় না। কিছু না কিছু তো ছাড় দিতেই হবে। আর কোরিয়ান অধ্যাপকরা টাকা নিয়ে আলোচনা করতে একদম পছন্দ করেন না। বেতনের প্রসঙ্গটাও ওরা কাউকে ল্যাবে যোগদানের সময়ই বলে নেন। যেনো পরে এগুলো নিয়ে আর ঝামেলা না হয়।  

যারা উচ্চশিক্ষার জন্য কোরিয়া আসতে চান তাদের জন্য উপদেশ

কোরিয়াতে এখন প্রচুর ভালো কাজ হচ্ছে। অবশ্যই এখন উচ্চশিক্ষার জন্য পুরো বিশ্বে কোরিয়া অনেক এগিয়ে আছে। যারা উচ্চশিক্ষার জন্য কোরিয়া আসতে চাচ্ছেন, নিঃসন্দেহে আসতে পারেন। তবে হ্যাঁ, পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই এখানে। নিজের দেশের ভাবমূর্তি যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোরিয়ান অধ্যাপকরাও এখন অনেক বাঙালি শিক্ষার্থী নিতে আগ্রহী। সুযোগ আছে, সেটাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলেই কিন্তু আসল পাওয়া।

একজন শিক্ষার্থী যখন প্রথম দেশের বাইরে আসে, তখন তার মধ্যে অনেক ধরনের দুঃশ্চিন্তা কাজ করে। কিন্তু একবার যদি সাহস করে চলে আসতে পারে, তাহলে এখানেও পাবে আর একটা বাংলাদেশি পরিবার। আর দেশের বাইরে যদি বাঙালি পরিবার পাওয়া যায়, এতে করে সবকিছুই অনেক সহজ হয়ে যায়।

আর সবশেষে আমার সব ছোট ভাই-বোনদের অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্য। সবার নাম বলে শেষ করতে পারব না, তাই সবাইকে একসঙ্গে অসংখ্য ধন্যবাদ।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ইউনিভার্সিটি অব উসলানের শিক্ষার্থীরা

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: shajia.shila@yahoo.com

লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!