জাপানের চিঠি: আমাদের চিকুনগুনিয়া, জাপানের লাল পিঁপড়া

চিকুনগুনিয়ার গুনাহ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আবাসন গেঁড়েছে। আর জাপানে এসেছে লাল পিঁপড়া।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2017, 04:03 AM
Updated : 17 July 2017, 08:34 AM

চিকুনগুনিয়ায় কাতর বাংলাদেশের মানুষ। আর জাপানে কেউ আক্রান্ত হয়নি লাল পিঁপড়ায়, তবে দৌড়ানিতে রয়েছে জাপানের মন্ত্রী আর কর্মকর্তারা।  কিন্তু কেন?

আমি যে শহরে থাকি, সেই ওসাকা শহরটি জাপানের প্রধানতম বাণিজ্যিক নগরী। মূলত বন্দর নগরী হিসেবে জাপানিদের কাছে বেশ পরিচিত। ওসাকার আশেপাশে অনেক বন্দর রয়েছে। এদের একটি হলো ‘কোবে পোর্ট’ বা ‘কোবে বন্দর’। দেশ-বিদেশের পণ্য আনা-নেওয়া পুরোদমে চলে সেখানে।

গত ২৬ মে, এই কোবে পোর্টে চীনের গুয়াংডাং প্রদেশ থেকে আসা একটি জাহাজের মাল খালাস করছিল শ্রমিকরা। হঠাৎ করে এক কার্গোতে পিঁপড়া চোখে পড়ে একজন শ্রমিকের। লাল পিঁপড়া দেখেই চমকে ওঠে তারা। সঙ্গে সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানানো হলো।

কর্মকর্তারা বিষয়টি পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে জানানোর পর চললো পুরোদমে গবেষণা। গুণে গুণে তারা নিশ্চিত হলো, সেখানে পাঁচশটি লাল পিঁপড়া রয়েছে, যেখানে একটি নারী ও চারটি পুরুষ, যারা বংশ বিস্তারের উপযোগী।

পরবর্তীতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিল, এই জাহাজের খালাস করা মালগুলো স্টেরালাইজ করা হবে। যাতে করে লাল পিঁপড়ার বংশ বিস্তার না হয়।যেমন কথা তেমন কাজ। ব্যাস, সেইভাবে স্টেরালাইজ কার্গো শ্রমিকরা খালাস করলো।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা হলো কয়েকশ’ কর্মকর্ত-কর্মচারী। যারা দেশজুড়ে ৬৮টি বন্দরে চিরুনি অভিযানে নেমে পড়ে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে লাল পিঁপড়াকে।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় দাবি করছে, দক্ষিণ আমেরিকার এই লাল পিঁপড়া ‘রেড ইমপোর্টেট ফায়ার আন্ট’ বা ‘রিফা’ নামে পরিচিত, যা কিছুটা বিষাক্ত। কারও কারও জ্বর, এলার্জি ও এনিফিলিস বা গোঁদ রোগের মতো রোগ হতে পারে। তাই সবাইকে সর্তকতামূলক বার্তা দিয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয় এদেশের নাগরিককে জানিয়ে দিয়েছে।

গত ৫ জুলাই আমাদের ওসাকা বন্দরে ৫০ পিঁপড়া পাওয়ার পর কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপকদের নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছে।

এই পিঁপড়া এখন পর্যন্ত কাউকে আক্রমণ না করলেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে দেশটির ২৯টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে লাল পিঁপড়া অনুসন্ধানে নেমেছে। জরুরি তদারকি করতে বিমানবন্দরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়ার পর বিমানবন্দরের কার্গো বিমান ও যাত্রীবাহী আন্তর্জাতিক বিমানগুলোতে চলছে পুরোদমে অভিযান।

পাঠানো হয়েছে চিকিৎসক দল। কিয়েতো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চলছে এই পিঁপড়ার ডিএনএ নিয়ে।

আপাত দৃষ্টিতে পিঁপড়াগুলোকে জাপানিরা ভয় পেলেও আমরা বাঙালিরা মনে হয় চিকুনগুনিয়ায় কোনো ভয় পাচ্ছি না। একের পর এক মশাবাহিত এই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তদের সংখ্যা দীর্ঘ হলেও আমাদের দেশে চলছে ‘ফেইসবুকে শোরগোল’। চলছে টিভি পাড়ায় টকশো। জ্বলছে রাজনৈতিক বক্তব্য। পরিবেশবাদী হয়েছে চুপ, ফেইসবুকে সরব কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্ম।

পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, চিকুনগুনিয়া আর জাপানের লাল পিঁপড়ার মধ্যে সম্পর্ক কী? কেন আমি জাপানের লাল পিঁপড়া নিধনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলাম?

কয়েকদিন আগে আমার এক জাপানি বন্ধু বাংলাদেশে যেতে চায় মর্মে আমার কাছে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চেয়েছিল। হিরোকি সুকাবো নামের এই বন্ধুকে আমি বললাম, বাংলাদেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। জঙ্গি দমনে সরকার বেশ সাহসী ভূমিকা পালন করছে। বলতে গেলে পুরোটাই এখন সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে।

আমার কথা শুনে সে হাসলো। সে বললো, সেটা আমি জানি। তবে কয়েকদিন থেকে তোমার দেশের ইংরেজি পত্রিকায় একটি শব্দ দেখছি ‘চিকুনগুনিয়া’। এটি নাকি ঢাকায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে?

আমি ওর কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়েছি! ভেবেছিলাম জাপানি মানুষ, গত বছরের জুলাইয়ের ঘটনায় কিছুটা উদ্বিগ্ন আছে, তাই তাকে নিরাপত্তার বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু উনি যে চিকুনগুনিয়ায় ভয় পেয়ে যাবেন, তা তো কখনো ভাবিনি।

এখন তো তাকে বলতেও পারছি না, চিকুনগুনিয়ায় ঢাকা নিরাপদ। এ তো দেখছি জঙ্গিদের চেয়ে ভয়ানক আকার ধারণ করেছে! তাই আমি আমতা আমতা করে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, চিকুনগুনিয়া ঢাকায় কিছুটা অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। আমি জানি না তোমার যাওয়া কতোটা নিরাপদ, তবে সাবধানে থাকতে পারার নিশ্চয়তা তোমাকেই নিতে হবে। মশারি টানানোর দায়িত্বটাও তোমাকে নিতে হবে।

আমার কথা শুনে সে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো। আমি আর বিস্তারিত কিছু বলতে যাইনি। যে দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য এই দেশের মন্ত্রণালয়গুলোর মন্ত্রী আর কর্মকর্তাদের ঘুম হারাম, যে দেশের সামান্য লাল পিঁপড়ার জন্য সমগ্র স্বাস্থ্য ও পরিবশে মন্ত্রণালয় জেঁকে বসেছে, সেই দেশের নাগরিকরা মশাকে ভয় পাবে না তো কিসে ভয় পাবে শুনি?

গত তিন বছরে আমার একটি মশা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এমনকি মশায় যে কামড় খেয়েছে, এমন কথাও কারও কাছ থেকে শুনিনি। আর শুনবই বা কেন? মশা তৈরি হওয়ার যে নিয়ামক পাওয়ার কথা, সেইগুলো তারা কোথায় পাবে?

এদেশে রাস্তায় না পড়ে থাকে কাগজের ঠোঙ্গা, না পড়ে থাকে কোনো আর্বজনা। সপ্তাহে তো দুই-একদিন বৃষ্টি হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোথাও এক পশলা বৃষ্টির পানি জমে থাকতে দেখিনি। বৃষ্টি থামার সাথে সাথে রাস্তাঘাট টনটনা। কোথাও জমে থাকে না নদর্মার জল। আর এই জন্য বন-জঙ্গল আর পাহাড় থাকার পরও এই যন্ত্র জাতি মশার কামড় খেতে পারে না।

শুধু কি তাই? এই দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো প্রতিটি হোল্ডিং বা রেসিডেন্টের কাছে গার্বেজ ব্যাগ সরবরাহ করে। প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনের জন্য আলাদা রঙের ব্যাগ। আপনার আবর্জনা অবশ্যই এই ব্যাগে ফেলতে হবে।

কোথাও কোথাও লাগাতে হয় নিদিষ্ট বাড়ি নাম্বারের ট্যাগ। যাতে করে আবর্জনা ফেলার নিয়ম ভঙ্গ হলে সিটি কর্পোরেশন ব্যবস্থা নিতে পারে।  প্রতিটি বড় বড় বাড়ির সামনে থাকে ভাগাড়। আর এই ভাগাড় থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে নেয় সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা।

এইবার আমি আমাদের চিকুনগুনিয়া আর সিটি কর্পোরেশের রাজাদের গল্প নিয়ে। চিকুনগুনিয়ায় যখন ঢাকাবাসী নাকাল, তখন সিটি কর্পোরশেন আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। দুই দপ্তরের এই কর্মকাণ্ড দেখে কে কতোটা খুশি হয়েছে আমি জানি না, তবে আমরা কিছুটা ব্যথিত হয়েছি বটে। মশারি ঘরে টানানো নিয়ে চলছে শোরগোল।

আমি সেই বিষয়ে কথা বলবো না। শুধু এইটুকু বলতে চাই, ঢাকাকে বাঁচতে দিন। চিকুনগুনিয়া হয়তো ভাইরাসবাহিত হয়ে কিছু মানুষকে আক্রান্ত করছে, কিন্তু ঢাকা যে মশক নিধনের ব্যবস্থপনা আছে, তাতে মশক নিধন নয় বরং বাড়ন্ত হবে- এটাই স্বাভাবিক।

যেখানে সেখানে আর্বজনার ভাগাড়, নর্দমার পানি, বর্ষার পানি, সুয়ারেজ লাইনের পানিতে যে একাকার, তা কিন্তু এই চিকুনগুনিয়ায় নয়, যে কোনো পানিবাহিত কিংবা বায়ুবাহিত রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে আজ  যারা কেবল সিটি কর্পোরেশনকে দুষছি, তারাও কি জানে, এই চিকুনগুনিয়ার বাহক মশকীর বংশ বিস্তারে তারাও দায়ী? আমরা নাগরিক হয়ে নিজেরাও যত্রতত্র আর্বজনা ফেলছি, সুয়ারেজ লাইন ক্লিয়ার না করে নোংরা পানির জলাশয় তৈরি করছি, তার জন্য কিন্তু আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না।

সিটি কর্পোরেশনও যদি আবজর্না ফেলার নীতিমালা তৈরি করে আইন করার সুপারিশ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাতে পারে। যদি মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করা না যায়, তা হলে এডিস মশা আজ  যে চিকুনগুনিয়া দিয়ে বিষ ছড়াচ্ছে, তা আগামীতে ভয়ানক কিছু ছড়াতে পারে।

তাই আমার মনে হয়, সবার সম্মলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব এই ধরনের সমস্যা দূর করার।

লেখক: 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জাপান প্রতিনিধি

ইমেইল: nadim.ru@gmail.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!