একজন রাকিব মামার স্নেহ

সিডনি থেকে খুলনায় এসেছি। রাকিব মামা একদিন বললেন, “ভাগিনা, কী খাবে?” আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, “কচুর লতি।”

নাইম আবদুল্লাহ, সিডনি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2017, 04:36 AM
Updated : 8 July 2017, 04:36 AM

মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেলেও মামা সেটাকে লুফে নিলো। আমি নিজের নির্বুদ্ধিতার কাছে আবারও হার মানলাম। এবার দেশে এসে ঢাকা ও খুলনার কাঁচা বাজারে তন্ন তন্ন করে কচুর লতি খুঁজেছি। দোকানিরা বলেছে, বৃষ্টি না হাওয়া পর্যন্ত লতি বাজারে আসবে না।

কিন্তু মামা ঠিকই কচুর লতি জোগাড় করে ফেললো। আমাকে জানালো, “ভাগিনা, কচুর লতি পাওয়া গেছে।” আমি বেকুব বনে গেলাম। বললাম, “ঠিক আছে মামা, লতিগুলো আমাদের দাও। আমরা বাসায় নিয়ে রান্না করে খাবো।” মামা অপমানিত বোধ করে চোখ-মুখ লাল করে আমাকে বলল, “তোমার মামী কি রান্না জানে না?”

আমি মামার কাছে হার মানলাম। আজ দুপুরে খেতে বসার ঠিক পনের মিনিট আগে হটপটে করে মামার বাসা থেকে মামীর রান্না করা কচুর লতি এলো। রাকিব মামা আমার মাত্র কয়েক বছরের বড়। কিন্তু আমার সাথে তার হাবভাব দেখলে মনে হয়, আমি এখনও প্রাইমারি স্কুলে পড়ি।

কয়েকটা উদাহরণ দেই। এবার বাড়িতে আসার পর আমার ছোট বোন নিফাত বলল, “ভাই আমাদের একটা লাইট ফিউজ হয়ে গেছে।” আমি দোকান থেকে লাইট কিনে মামার অফিসে গেছি। “ভাগিনা, হাতে ওইটা কী?” “মামা, আমাদের বাসার একটা লাইট ফিউজ হয়ে গেছে। তাই একটা লাইট কিনেছি।” তখন মামার সাথে তার বন্ধুরাও ছিল।

মামা আমাকে তাদের সামনে এই মারে তো সেই মারে। তোমাকে এই লাইট কিনতে কে বলেছে? দোকানদার বলল, এই ব্র্যান্ড ভালো, এইটা নিয়ে যান। তুমি লাইটের কি বোঝো। কোন কিছু কিনবার আগে আমাকে অন্তত জিজ্ঞাসা করবা। আমি ভালবাসার গভীরতা থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। মামা আমাকে ধমক দিয়ে এই সমুদ্রেই ফেলে দেয়। আমার শিক্ষা হয়ে যায়।

খুলনায় গেছি আম্মার ব্লাড প্রেসার মাপার মেশিনটা ঠিক করাতে। সেখানে আমার এক স্কুল বন্ধুর সাথে দেখা। সে আমাকে বলল, দোস্ত চল আমি তোমাকে নিয়ে যাই। তক্ষুনি মামার রাশভারী চেহারার কথা মনে পড়লো। বন্ধুর সামনেই মামাকে ফোন করলাম। মামা বলল, বড় বাজারের হাসান সার্জিক্যালে চলে যাও। ওরা তোমাকে বলে দেবে, কে এই মেশিন ঠিক করে।

আমার বন্ধু আমাদের কথাবার্তা শুনে হেয়ালি করে বলল, আরে দোস্ত, আমি তো তোকে ওখানকার কথাই বলতে চাইছিলাম। আমি বললাম, আমি যদি মামাকে না জানিয়ে এই মেশিন ঠিক করে নিয়ে যাই আর মামা যদি জানতে পারে তাহলে আমার একদিন কি মামার একদিন।

আরেক দিনের কথা। যতবার আমি বাড়িতে আসি দৌলতপুর ডেইরি থেকে দই-মিষ্টি কিনি। এটা মামার নির্দেশ। কারণ মামা গিয়ে ওদের সাথে আমার পরিচয় করে দিয়েছে।

এইবারও ওই দোকান থেকে দই কিনে পড়লাম মামার কবলে। মিষ্টি মহল ভালো দই মিষ্টি বানায়, তুমি কেন দৌলতপুর ডেইরি থেকে এসব কিনেছ? মামা তুমিই না বলো, দৌলতপুর ডেইরির মিষ্টি, দই ভালো। মামা তেড়ে আসে। আমি কি সারাজীবন ওই দোকান থেকে তোমাকে কিনতে বলেছি। আমি মামার স্নেহের কাছে হার মানি।

মামা ছোটবেলায় খুবই ডানপিটে আর আমি খুব ভিতু প্রকৃতির ছিলাম। আমার দৌড় ছিল আমাদের বাড়ির গেটের সামনে পর্যন্ত। মামার সব বন্ধুরা মিলে আম, পেয়ারার সময় পশ্চিমপাড়ায় আম চুরি করতে যেত। আমি ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ফেরার পথে আমি গেটের সামনে না থাকলে মামা গেটে ধাক্কা দিতো। আমি দৌড়ে গিয়ে মামার সামনে হাজির হতাম। মামা তার প্যান্ট ও কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে থেকে পাকা আম, পেয়ারা বেছে বেছে আমাকে দিয়ে যেত।

আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আমার এক খালাতো বোন বকুল আপার বিয়ে। ছবি তুলতে হবে, ক্যামেরা লাগবে। মামা তার বন্ধু তুহিনের কাছ থেকে ক্যামেরা চেয়ে এনে আমাকে দিয়েছিল। বিয়েতে যাবো একটা সুন্দর শার্টও লাগবে। মামার শার্ট আমার সাইজে ছোট হয়। মামা গিয়ে বাকু মামার একটা শার্ট চেয়ে নিয়ে ধুয়ে আয়রন করে আমাকে পরিয়ে দিলো।

ওই সময়ই আমার ছবি তোলার নেশা চাপলো। মামা তখনও স্টুডিওর ব্যবসা শুরু করেনি। তাতে কুচ পরোয়া নেহি। ভাগিনার সখ বলে কথা। তখন সাদা কালোর যুগ। মামা ক্যামেরা জোগাড় করে দৌলতপুর কৃষি কলেজের পানির টাওয়ার থেকে শুরু করে বাধাকপি ক্ষেতে ছবি তোলা কোনটাই বাদ গেল না। ছবি তোলার পর তুলু মামার স্টুডিও থেকে অসীমের মাধ্যমে প্রিন্ট করার ব্যবস্থাও মামাই করে দিলো।

মাঝে মাঝে অস্ট্রেলিয়া থেকে টাকা পাঠালে এখানকার ব্যাংকে আসতে দেরি হয়। এটা আমার জন্য কোন সমস্যা না। মামাকে ফোনে বললে টাকা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যায়।

২০০২ সালে বিয়ে করতে এসেছি। পাত্রী খুঁজে পাচ্ছি না। মামা-মামীর ঘুম হারাম হয়ে গেল। আমাদের আশপাশের স্থানীয় অবিবাহিতা মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি হল। মামা-মামী তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সব কর্মচারীসহ বাটি চালান দিয়ে আমার জন্য পাত্রী খুঁজতে নেমে গেল।

বিয়ে ঠিক হওয়ার পরও মামার চোখে ঘুম নেই। কেনা কাটা, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বৌভাত ভিডিও করা সব কিছুতেই মামা। বৌ ভাতের আগের রাতে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে খাসি জবাই হচ্ছে। মামা আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে সারারাত কসাইদের পাহারা দিলো যাতে তারা মাংসে পানি দিয়ে ওজন বাড়াতে না পারে।

প্রতিবার আমরা আসলে মামা মেজারমেন্ট টেপ আর কাগজ কলম নিয়ে বাসায় হাজির। জিজ্ঞেস করি, মামা সমস্যা কী? মামা গায়ে মাখে না। আমার ছেলে আরিকের জামা-কাপড় কেনার জন্য মামা তাকে খুঁজছে। আমি বাসায় আসার আগেই আমার জন্য মাম পানির বোতল বাসার সামনে হাজির।

আব্বা অবাক হয়ে আম্মাকে জিজ্ঞাসা করে, নাইম তো এখনও আসে নাই, পানি রেখে গেল কে? আম্মা মুচকি হেসে বলে, রাকিব ছাড়া আবার কে! মামাদের পরিবার অনেক বড়। ওনার ভাগিনা-ভাগ্নির সংখ্যা বোধ করি দেড় ডজনেরও বেশি হবে।

কিন্তু আমি কখনও হিসাব মিলাতে পারি না, মামা কেন এই আঠারো জনের সবটুকু ভালবাসা আমাকে উজার করে দিয়েছে। আমার এই ভাবনাটাও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। কারণ স্নেহ, মমতা, ভালবাসার ডাক অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারো নেই।

লেখক: প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক

 এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!