কাপড়ের ভাঁজে যেখানে বাংলাদেশ লেখা

বাংলাদেশের তৈরি কাপড় আমদানীতে পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশ জার্মানি। এখানে কাপড়ের দোকানে গেলে দেখা যায় অনেক টিশার্টে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা থাকে৷

মাহবুব মানিক, জার্মানির হালে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2017, 08:49 AM
Updated : 30 June 2017, 08:49 AM

বড় কোন কাপড়ের দোকানে ঢুকে সবাই যখন টিশার্টের রং, ডিজাইন, প্রিন্ট ও সাইজ দেখতে ব্যস্ত থাকে; আমি তখন উল্টে-পাল্টে দেখি কোথায় এটা তৈরি হয়েছে৷ মনে মনে আশা করি যেন বাংলাদেশের তৈরি হয়৷

যখন দেখি টিশার্টের কোন অংশে ছোট্ট করে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ কথাটা লেখা আছে, প্রশান্তিতে বুকটা জুড়িয়ে যায়৷ চিৎকার করে মানুষগুলোকে ডেকে ডেকে দেখাতে ইচ্ছা করে৷ দেখো দেখো, দেখে যাও তোমরা৷ এটা আমার দেশের তৈরি৷ আমার বাংলাদেশের তৈরি৷ পারি না, চিৎকার করে লোকজন জড়ো করাটা এদেশের কালচারের মধ্যে পড়ে না৷ অনেক সুখানুভূতি তাই চেপে যেতে হয়৷

আমার একটা পুরনো অভ্যাস আছে৷ এটাকে বদভ্যাসও বলা যেতে পারে৷ যখন দেখি কোন টিশার্ট বাংলাদেশের তৈরি, মনের অজান্তে টিশার্টের ভেতর সেলাই বরাবর আলতো করে হাত বোলাই৷ কাপড়ের ভাঁজে যেখানে বাংলাদেশ নামটা লেখা সেখানে স্পর্শ করি৷ কাপড়ের পরতে পরতে হাতের সংবেদনশীল তালু দিয়ে ছুঁই৷ অনুভব করি এ টিশার্ট আমার দেশের কোন না কোন ভাই বা বোন পরম মমতায় তৈরি করেছেন৷

তারা হাত দিয়ে স্পর্শ করেছেন, পরিশ্রমে ক্লান্ত আমার ভাই বা বোনের নোনতা ঘামের একটা অংশ হয়তো টিশার্টে শুকিয়েও গেছে৷ হতে পারে আমাদের স্পর্শ করার মুহূর্তটা ভিন্ন৷ হতে পারে সেটা এক মাস, কি এক বছর৷ তবুও কেমন যেন এক রকম প্রশান্তি অনুভব করি৷ আমার দেশ, আমার বাংলাদেশের গন্ধ পাই ৷ সেলাইয়ের মাঝে বাংলাদেশ দেখি, কাপড়ের পরতে পরতে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা করি৷ 

বাংলাদেশি কোন ভাই বা বোনের হাতের স্পর্শ লেগে আছে, এটা ভাবতেই একটা মানসিক প্রশান্তি পাই ৷ বাংলাদেশের কোন না কোন একটা এলাকা, মেঠো পথ, আমার চেনা জানা বা অচেনা মানুষ, জনপদ সব কিছুই এ টিশার্ট হয়তো ঘুরে দেখে এসেছে৷ সবচেয়ে বড় কথা এ টিশার্ট আমার বাংলাদেশ দেখে এসেছে৷ কোন না কোন অলিগলিতে এ টিশার্টের জন্ম৷ বাংলাদেশের তাপমাত্রা, আদ্রতা, আবহাওয়া অনুভব করে এসেছে৷ মনের অজান্তে নিজেও সেটা অনুভব করার বৃথা চেষ্টা করি৷

কোন না কোন ভিনদেশি মানুষ হয়তো টিশার্টগুলা কিনবে৷ আমার দেশের মা-মাটির গন্ধ তারা গায়ে জড়াবে৷ দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ি, ছোট্ট করে লেখা ‘বাংলাদেশ’ নামটা তাদের চোখে পড়বে তো? নাহ এরা এত ছোট্ট করে ‘বাংলাদেশ’ কথাটা লিখেছে কেন? দূর থেকে টিশার্ট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকটা অচেনা বিদেশিদের দৃষ্টিতে ‘বাংলাদেশ’ লেখাটা পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করি৷ নাহ, বোঝা যাচ্ছে ভালোই৷

গোটা গোটা অক্ষরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’৷ তাদের চোখে পড়বেই পড়বে৷ একদিন দু’দিন তো আর গায়ে দিবে না, চোখে পড়বেই লেখাটা৷ তাদের কি আগ্রহ হবে? দেশটা কেমন? একটু জানি৷ উইকিপিডিয়াতে একটু ঢু মেরে দেখি৷ বাংলাদেশের আয়তন কতো? মুদ্রা কি? কবে স্বাধীনতা পেয়েছে? মানুষগুলো কেমন?

আদতে আমরা ক্ষুদ্র একটা দেশের বড় সংখ্যার মানুষ ৷ আমাদের গায়ের চামড়া মুখের আকৃতি দেখলে এরা মোটামুটি নিশ্চিত থাকে আমরা হয় ভারতীয় নয়তো পাকিস্তানি৷ কিন্তু যখনই বলি- জ্বি না, আমি বাংলাদেশি৷ বাস্তবে দেখা যায় তারা ভ্রু কুঁচকে কি একটা ভাব করে৷ এটা শোনার জন্য হয়তো তারা অপ্রস্তুত ছিল৷ তখন খুব দুঃখ হয়, নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হয়৷

আসলে বাংলাদেশ নাম সম্পর্কে পাড়া-গাঁয়ে বাস করা কম শিক্ষিত ভিনদেশি মানুষদের এখনো ধারনা কম৷ এখনো আশাহত হইনি, তাদের পরনের পোশাকগুলার মধ্য দিয়ে হলেও আগে ভাগে জেনে নিবে বাংলাদেশ নামের একটি দেশ আছে৷ এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো আর অপ্রস্তুত থাকবে না৷ চমকে যাবে না৷ অচেনা অজানা কোন নাম হঠাৎ শুনে ফেলেছে এমন ভাবটা হয়তো তাদের মধ্যে থাকবে না৷

বাংলাদেশ নামটা শুনে অল্প সময়ের জন্য হলেও কল্পনা করবে, তাদের গায়ের টিশার্টটি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে৷ পরনের প্যান্ট, কাঁধের ব্যাগটাও তৈরি হয়েছে আমার বাংলাদেশে, আমাদের বাংলাদেশে৷

লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি

ইমেইল: mahbub_chkbd@yahoo.com

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!