এই আনন্দের মিছিলে আমি সামিল হতাম। আজানের সাথে সাথে ঠিক সময়ে ইফতারি খাবার রীতিমতো অভ্যাস ছিল। আমরা বাঙালিরা সব ধর্মের উৎসবে মেতে উঠি। এটা আমাদের বাঙালিদের বিশেষ একটা গুণ।
রোজার স্বাদ নেওয়ার বিশেষ একটা কারণ ছিলো। আমার জন্ম চট্টগ্রামের বাঁশখালীর শীলকূপ গ্রামে। অনেক বড় এ গ্রামের দুটি অংশ, পূর্ব শীলকূপ ও পশ্চিম শীলকূপ। পূর্ব শীলকূপ হলো বৌদ্ধ অধ্যূষিত অংশ। এর পাশে কিছু অংশে মুসলিম ও অনতিদূরে হিন্দুপাড়া। ওরা সংখ্যায় বৌদ্ধদের চেয়ে কম। কিন্তু সবার সাথে সম্পর্ক ছিলো একই পরিবারের মতো।
পরস্পরের আন্তরিক সহযোগিতায় ধর্মীয় উৎসবগুলো আমরা অনেক আনন্দের সাথে পালন করি ও উপভোগ করি। বোঝার কোনো অবকাশ নাই যে, কে মুসলিম, কে বৌদ্ধ, কে হিন্দু। পরষ্পরের ভ্রাতৃত্ববোধ, ভালবাসা ও সম্প্রতিতে ভরপুর শীলকুপ গ্রাম।
এইচএসসি পাশ করার পর মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ার সুবাদে যাদের সাথে আমি রুমমেট হিসেবে থাকতাম তারা কেউ মুসলিম, কেউ হিন্দু ধর্মালম্বী। রোজার মাস আসলেই আমরা সবাই মুসলিম রুমমেটদের সাহায্য করতাম। সেহেরি থেকে শুরু করে ইফতারি বানাতাম ও একসাথে সবাই অনেক আনন্দের সাথে ইফতারি করতাম।
কথা প্রসঙ্গে মুসলিম বন্ধুদের কাছে জানতে পেরেছি রোজার অর্থ সংযম। তা কেবল অর্থের সংযম নয়। চিত্তের সংযম, মনের সংযম, কর্মের সংযম ও বাক্যের সংযম। এই সময়টায় যারা রোজা থাকে তাদের আচার, ব্যবহার, রীতি-নীতি দেখে আমি অনেক মুগ্ধ হতাম। তারা সত্যিকার অর্থে অনেক ঈমানদার।
তারাও আমার কাছে জানতে চাইতো আমাদের বৌদ্ধদের কোন রোজার মতো আচার রয়েছে কিনা! আমার মাধ্যমে তারা জানতে পারলো যে রোজার মতো আমাদেরও উপবাস আছে। এই উপবাসের অর্থ হলো মন পরিশুদ্ধ করার সংযম। তবে আমরা পানি পান করতে পারি। পানি খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা হচ্ছে যাতে কিডনিতে কোন পাথর না জমে, প্রস্রাবে কোন সমস্যা না হয় ও দেহের পানির চাহিদা ঠিক রাখা। তবে মনের সংযম যদি ঠিক থাকে, সবই ঠিক। মন ঠিক না থাকলে ও যথার্থভাবে পালন না করলে, রমজান বা উপবাসের অর্থ উপহাস হয়ে যেতে পারে।
সেসব বন্ধুরা যখন রোজা থাকতো, তখন আমি উপবাস থাকতাম। প্রতি বছর যখন রমজান আসে তখন আমি আমার সেসব বন্ধুদের অনেক মিস করি। আর মাঝে মাঝে অনেক আক্ষেপ করি সেই সময়টার জন্য। জানি, হয়তো সেই সময় আর ফিরে পাবো না। সময় না আসুক তাতে কি, রোজা আসবে তার সংযমের বাণী নিয়ে, মৈত্রী আর শান্তি নিয়ে। যাতে সেই সংযম যেন ভেঙ্গে না পড়ে রাঙামাটির লংগদুর মতো।
রোজার এ পবিত্র দিনে সব সংযম উপেক্ষা করে আদিবাসীদের উপর যেভাবে নির্যাতন ও ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো, তাতে বিশ্বমানবতা ও শান্তি পদদলিত হলো নির্মমভাবে।
সেইদিন আমি অনেক মিস করেছি আমার সেইসব বন্ধুদের, যাদের কাছে আমি রোজার অর্থ দেখেছি, পবিত্রতা দেখেছি ও সংযম দেখেছি।
তারা কি পারে না সেই সব অজ্ঞদের কাছে গিয়ে রমজানের অর্থ যে সংযম তা বুঝাতে? যাতে রাঙামাটির লগংদুর মতো মানবতা পদদলিত না হয়!
লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ কানাডা প্রেস ক্লাব, প্রবাসী বাংলাদেশি
ইমেইল: purnima.susanta@yahoo.com
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |