প্রবাসীর স্মৃতিকথা: স্কুলের ডং ডং ঘণ্টা ও টিফিন

তখন কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে পড়তাম৷ সকাল থেকে একের পর এক ক্লাস নামের তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে দুপুরের টিফিনের জন্য ছিল নিরলস অপেক্ষা৷

মাহবুব মানিক, জার্মানির হালে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2017, 11:34 AM
Updated : 12 June 2017, 11:34 AM

ক্লাসের বড় বড় জানালার বাইরে তখন কাঠফাটা রোদের উত্তাপ৷ জানালার মোটা লোহার শিক গলে সেই উত্তাপ ছোঁয় বাড়ন্ত শরীর৷ তিব্র গরমে শরীরের মধ্যে তখন হাসফাঁস অবস্থা ৷ মাথার উপরে ঝুলন্ত ব্রিটিশ আমলের ফ্যানের ঠকাস ঠকাস, ঘ্যাষ ঘ্যাষ আর ফ্যাস ফ্যাস শব্দের তুলনায় আউটপুট অর্থাৎ বাতাস অনেক কমই মিলতো৷

টিফিন শুরু হওয়ার আগের ক্লাসের শেষ মুহূর্ত যখন চলে, তখনই বকুল ভাই টিফিনের হলুদ ছোট্ট গোলাকার ডিব্বাটা ক্লাসে স্যারের টেবিলের পাশে পৌঁছে দিয়ে যেতেন৷ ডিব্বার ভেতরের মুখরোচক ভাজা অজ্ঞাত জিনিসটার সুগন্ধে তখন সারা ক্লাস মৌ মৌ অবস্থা৷ সুগন্ধটা আমাদের সবার নাক ছুঁয়ে লোভ জাগিয়ে ক্লাস রুমেই ঘুরে বেড়ায়৷ না যায় ধরা না যায় সহ্য করা৷

বকুল ভাই আর বেঁচে নেই৷ শুনেছি কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন৷ বকুল ভাই ছিলেন অফিস পিওনদের একজন৷ বকুল ভাইকে যখন দেখেছিলাম তখন তার মুখে কোন দাড়ি ছিলনা ৷ সুদর্শন ফর্সা একজন যুবক৷ বহু বছর পর দেশে যখন ছিলাম তখন তার মুখে দরবেশ টাইপের দাড়ি দেখেছিলাম৷ যতদূর শুনেছিলাম মৃত্যুর সময়ও তিনি এ বেশে ছিলেন৷

টিফিনের ডং ডং ঘণ্টার শব্দ শোনার অপেক্ষার পালা৷ অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে নিচতলা থেকে কাসার প্লেটে কাসার হাতুড়ির ডং ডং ঘণ্টার শব্দ সারা বিল্ডিং কাঁপিয়ে দিতো৷ ঘণ্টার শব্দ শোনামাত্র হলুদ রংয়ের ছোট টিনের ডিব্বা থেকে আমাদেরকে টিফিন বিতরণ করা হতো৷ বিতরণের দায়িত্ব থাকতো ক্লাস ক্যাপ্টেনের৷

ওই মুহূর্তটা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম, আজকের টিফিনে কোন চমক আছে কিনা! চমক বলতে আমাদের জন্য একটাই সারপ্রাইজ ছিল, সেটা হচ্ছে ডিম প্যাটিস৷ তবে সেটা মিলতো নিতান্ত কালেভদ্রে৷ বেশিরভাগ দিনে থাকতো ছ্যাবড়া ছ্যাবড়া প্যাটিস, ড্যানিশ, ডালপুড়ি ও লাড্ডু বা সিঙ্গারা৷ যাই মিলতো যতটুকুই মিলতো ক্ষুধার্ত পেটে গরুর মতো জাবর কাটতে কাটতে দলবল বেধে হৈচৈ করে বাইরে চলে আসতাম, হাতে সময় থাকতো মাত্র ত্রিশ কি পয়ত্রিশ মিনিট৷

স্কুল বিল্ডিং এর সামনেই ছিল ইটের নিঁচু গোলাকার দেয়াল ঘেরা শহীদ মিনার৷ যার চারপাশের জায়গাটা ছিল আমাদের খেলার মাঠ৷ মাঠভর্তি ছিল ঘন আম গাছ৷ বাইরের গরম রোদের মাঝে আমবাগানের ছায়া মনে হতো আরশের ছায়া৷ ছায়ার মাঝে আলম ভাইয়ের চটপটি, মুড়ি মাখানো আর সিভিটা শরবতের দোকান৷

কাঠফাটা গরমের মধ্যে আলম ভাইয়ের চটপটি বা মুড়ি মাখানোর থেকে প্রায়োরিটি বেশি থাকতো সিভিটা শরবতের৷ চার চাকার ভ্যানের উপর বড় বড় মোটা নীল রংয়ের প্লাস্টিকের বোতলভর্তি ঠাণ্ডা সিভিটা শরবত৷ হলুদাভ কমলা রংয়ের পানীয়, যার মধ্যে অসংখ্য ছোট বড় ভাঙা বরফের টুকরা ভাসতো, একটা ভিন্ন রকম আকর্ষনীয় গন্ধ, আমরা সিভিটা খোরেরা গরমের মধ্যে ঠাণ্ডা সিভিটার গন্ধ অনুভব করতাম৷

দোকানদার যখন প্লাস্টিকের মগ চুবিয়ে সিভিটা শরবত উলোট পালোট করতো, অমৃতের মতো গন্ধটা নাকে ভেসে আসতো৷ পেপসি বা কোকাকোলার লম্বা বোতলভর্তি সিভিটার দাম ছিল দুই টাকা, আর সেভেন আপের বোতলটা একটু বাটুল টাইপের বলে দাম ছিল মাত্র এক টাকা৷ এরপর বোতলের মধ্যে ডুবিয়ে দিতো রং-বেরং এর প্লাস্টিকের সিপার বা চিকন পাইপ৷

গরমের মধ্যে যখন চিকন নল দিয়ে গলার মধ্যে বরফ জলের ঠাণ্ডা সিভিটা শরবত ঢুকিয়ে দিতাম, গ্রীষ্মকালের কাঠফাটা রোদে ফাটল ধরা জমিতে ঠাণ্ডা বৃষ্টির পানি আছড়ে পড়লে যেমন তৃষ্ণার্ত জমি ঠাণ্ডা ও কোমল হয়ে যেতো, গলার ভেতরটা ঠিক তেমনই কোমল ও ঠাণ্ডা হয়ে যেতো। স্পষ্ট টের পেতাম ঠাণ্ডা সিভিটার পানি খাদ্যনালীর কতটা পথ অতিক্রম করে পাকস্থলীর দিকে এগুচ্ছে৷ 

যা বলছি এটা আজ থেকে বিশ-পনেরো বছর আগের ঘটনা৷ জীবনের বহু চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আজ আমি জার্মান প্রবাসী৷ আজ সিভিটার স্বাদ প্রায় ভুলতে বসেছি, হয়তো ভিটামিন-সি জাতীয় পানীয়গুলোতে এখনো স্বাদ হালকা মিলে৷ তবে সেই স্বাদ পুরোটা সিভিটার সাথে যায় না৷ স্বাদ ভুললে কি হবে, সিভিটার সেই রংটা কখনোই ভুলতে পারি না৷

রোজার মাস আসলে যেন বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে যাই৷ জার্মানিতে সারাদিন লম্বা সময় রোজা রেখে তৃষ্ণার্ত থেকে বিকেলবেলা ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্তের ইউরিনের রংটা দেখলে সেই আবেগ একটু বেশিই বেড়ে যায়৷ দুঃখজনক হলেও মজার বিষয় হচ্ছে, পানিহীন শরীরের ঘন ইউরিনের রং ছোটবেলার সেই সিভিটার হলুদাভ কমলা রংকে আজো মনে করিয়ে দেয়৷

লেখক: বৈজ্ঞানিক গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি ৷

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!