প্রবাসের চিঠি: লাল সবুজের খোঁজে

বিদেশে বাংলাদেশের কোনো কিছু চোখে পড়লে মনটা আবেগ্লাপুত হয়।  হাজার মাইল দূরে প্রবাসে থেকেও মনের ভেতরটা সারাক্ষণ প্রিয় বাংলাদেশকেই খোঁজে।

আদনান সাদেক, জার্মানির লিওনবার্গ থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2017, 09:01 AM
Updated : 16 May 2017, 09:01 AM

পথে ঘাটে দেশের মানুষ, বাংলায় লেখা যে কোনো জিনিসপত্র অথবা বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আছে এমন যে কোনো কিছু আবিষ্কার করলে ভেতরটা আর্দ্র হয়ে আসে। যারা বাংলাদেশে থাকেন তারা প্রবাসীদের এই আবেগের মূল্য বুঝতে পারবেন না, তারা ভাববে এটা লোক দেখানো আদিখ্যেতা! এই আবেগ বুঝতে হলে মাটি থেকে শেকড় উপড়ে ফেলে দেশ থেকে বাইরে পা দিতে হবে।

গত এক যুগে পথেঘাটে অনেক বিদঘুটে জায়গায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে, অপরিচিতজনের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপনজনের মত গল্প হয়েছে, অনেকবার অনেক দোকানে গিয়ে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা দেখে অজান্তেই অদরকারী কাপড়েও হাত বুলিয়েছি।

তবে একটা জিনিস কখনো চোখে পড়েনি, সেটা হল বাংলাদেশের পতাকা। যদিও নিজের গাড়িতে সব সময় ছোট একটা বাংলাদেশের পতাকা ঝোলে, কিন্তু পথেঘাটে অসংখ্য পতাকার মাঝে নিজের দেশের পতাকা হঠাৎ করে দুলতে দেখার আনন্দটাই অন্যরকম।

আজকে পথের মাঝে হঠাৎ করে আমার স্ত্রী গাড়ি থেকে না দেখিয়ে দিলে খেয়ালই করতাম না জিনিসটা। জার্মানির একদম দক্ষিণ সীমান্তে যেখানে আমরা সবাই মিলে ছুটি কাটাতে এসেছি, যেখান থেকে আরও দক্ষিণ দিকে তাকালে মেঘের গাঁ ঘেঁষে সারি সারি আল্পস পর্বতমালার অপার্থিব সব দৃশ্য চোখে পড়ে।

পথের পাশে দোকানিবিহীন ফলের দোকান

সেই কনস্ট্যান্স লেকের পাড়ে অচেনা ক্ষুদে একটা গ্রামের প্রধান সড়কের পাশে সবুজের মাঝে লাল সূর্যের একটা বাংলাদেশের পতাকা। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস হয় না। পথের পাশে হুশ করে গাড়ি থামিয়ে নিলাম। একবার কাছ থেকে না দেখলেই নয়!

হতাশ হয়ে আবিষ্কার করলাম এটা কোন পতাকা নয়, বরং একটি বিজ্ঞাপন। এখানে আপেল এবং অন্যকিছু ফলমূল বিক্রি করা হচ্ছে। সবুজের মাঝখানে একটা গোলাকার লাল আপেল দূর থেকে দেখে বাংলাদেশের পতাকা বলে ভ্রান্তি হয়। এই বিজ্ঞাপনের মধ্যে এক ধরণের চমক ছিল। সেই সাথে মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার একটা ঘটনা।

ছোটবেলায় আমাদের পাড়ায় একজন অন্ধ ভিক্ষুক রাস্তার পাশে ছালা বিছিয়ে একটা থালা নিয়ে ভিক্ষা করতে বসতেন। তার সামনে রাখা টিনের থালায় একটা পয়সা পড়লে টুংটাং করে শব্দ হতো। সেই শব্দ শুনলে তিনি সুমধুর সুরে আল্লাহ নবীজির নাম নিয়ে কয়েকটা লাইন সূরা পড়তেন। তার গলা এতো সুন্দর ছিল যে, শুধু তার গলার স্বর শোনার জন্য আমি কয়েকবার পাঁচ পয়সা থালায় ছুঁড়ে দিয়েছি। ভিক্ষার পরিমাণ পাঁচ পয়সা হোক আর আট আনা হোক, অন্ধ ভিক্ষুক প্রতিবারই ভিক্ষা পেলে সুরেলা কণ্ঠে সম্পূর্ণ সূরা পড়ে শেষ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন।

জার্মান ভাষায় ফলের দাম লেখা, সামনের খোলা ড্রয়ারে টাকা রাখার অনুরোধ

পাড়ায় অবশ্য সবাই সূরা শুনে মুগ্ধ হতেন না। যেমন আমাদের বদ একটা পাড়াতো ছেলে। সে টিনের থালায় দশ পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে ভাংতি নেবার ছল করে পঞ্চাশ পয়সা নিয়ে চলে যেতো। অন্ধ ফকির অবশ্য সেটা টের পেতেন না। তিনি সরল বিশ্বাসে গলা খুলে বদছেলেটার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। এই ঘটনায় অনেকে মজা পেলেও আমার কেমন একটা কষ্ট হতো।

এক সময় বড় হয়ে গেলেও সেই কষ্টের কথা ভুলতে পারিনি। বিভিন্ন সময়ে খেয়াল করেছি মানুষের সরল মনের বিশ্বাসকে প্রায় সময়ই দুষ্টলোক অপব্যবহার করে।

আজকের আপেল বিক্রির লাল সবুজ রঙ চঙা দোকানের বিশেষত্ব হল, এখানে কোন দোকানদার নেই, ক্যাশবক্সে কোন তালা নেই। টেবিলের উপর ক্ষেত থেকে আনা আপেলসহ অন্যান্য ফল সারি করে প্যাকেট করে রাখা আছে। পথের পাশ দিয়ে গাড়ি করে বা হেঁটে যাচ্ছে এমন যে কোনো পথিক সেখানে খোলা ড্রয়ারে দুই ইউরো দিয়ে একটা আপেলের প্যাকেট নিয়ে যেতে পারবেন।

মালিক প্রতিদিন সকালে এসে নতুন করে আপেল রেখে যাবার পাশাপাশি ড্রয়ার থেকে আগের দিনের দাম সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরবেন।

পতাকা দেখতে না পারার হতাশা ভুলে মনে হল, আমরা যদি শুধু আমাদের আশপাশের মানুষগুলোকে বিশ্বাস করতে পারতাম, আর সেই সাথে আমাদেরকে বিশ্বাস করা মানুষগুলোর বিশ্বাসটুকু আবার যত্ন করে ফিরিয়ে দিতে পারতাম, তাহলে দেশছাড়া হয়ে আজকে এতো বছর ধরে মনের অজান্তে এই বিদেশে এক টুকরো লাল-সবুজ খুঁজে বেড়াতে হতো না।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি

ইমেইল: adnanbuet@yahoo.com

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!