‘আটলান্টিক পাড়ের রূপসী আজো তোমায় ভুলিনি’

আমি পর্তুগালকে ‘আটলান্টিক পারের রূপসী কন্যা’ বলে ডাকি। ডাকবো নাই বা কেনো? এই দেশের মাটি, বাতাস, পানি, নদী ও পুরনো শহরগুলোর প্রেমে তো আমি পড়েছিলাম।

জাফর তালহা, ফ্রান্স থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2017, 10:53 AM
Updated : 21 April 2017, 10:55 AM

এই দেশটিতে লন্ডনে ক্যানারি ওয়ার্ফের মতো নেই উঁচু উঁচু ব্যবসায়িক দালান। পর্তুগালের বাতাসে নিউ ইয়র্কের মতো বড় বড় ডলারের গন্ধ পাওয়া যায় না। অথবা দুবাই কাতারের মতো মার্বেল পাথর দিয়ে খোদাই করা বুর্জ অব দুবাইয়ের মতো চোখ ধাঁধানো অট্টালিকা নেই এখানে। তবে এখানে আছে এক অকৃত্রিম ভালোবাসা, মায়ার টান যা এখানে না ঘুরে গেলে উপলব্ধি করা যাবে না।

জানি না কেনো লাগোস, লিসবন ও পর্তোতে এই অসম ভালোবাসার টান অনুভব করলাম। তা আটলান্টিকে স্রোতে ভেসে আসা পৃথিবীর সব ভালোবাসা পর্তুগালের শহরগুলোতে লেপ্টে পড়া ভালোবাসা না ইবনে বতুতার রেখে যাওয়া কোন অলৌকিক আকর্ষণ, যা তার মতো ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য পর্তুগালের জন্য।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে দুই সপ্তাহের জন্য আমরা ১৫ জনের একটি গ্রুপ দুটি মিনিবাসে করে ফ্রান্স থেকে পর্তুগালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। যার মধ্যে আমি ও রাজু বাংলাদেশি আর বাকিরা সবাই ফরাসি। মিনিবাসে করে পর্তুগাল দূরের পথ। তাই পথিমধ্যে দুই রাত আমরা স্পেনের দুটি শহরে ক্যাম্পিং করে থেকেছি। শহর দুটির নাম এই মুহূর্তে মনে নেই। 

সফরের তৃতীয় দিন দুপুরের দিকে আমরা প্রথম পর্তুগালের লাগোস শহরে ঢুকলাম। শহরে ঢুকতেই আমি আঁচ করতে পারলাম এখানকার মানুষের মাঝে অন্যান্য ধনী দেশের মানুষের মতো অস্থিরতা নেই। বাড়ি-ঘর দোকানপাটগুলো সম্পূর্ণ সাধারণ মানের তৈরি। মানুষের হাঁটা চলাচল শান্ত। ট্রেনের মধ্যেও কোন হুড়োহুড়ি নেই। দুপুরে খাবারের জন্য একটি শপিং মলে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম এখানকার জিনিসপত্রের দামও বেশ কম।

আগে থেকে পর্তুগালে বসবাসরত আমার আত্মীয় -স্বজন থেকে জেনেছিলাম মাঝারি মানের রোজগার থাকলে পর্তুগাল জীবন-যাপনের জন্য একটি আরামের দেশ। আমি প্রথম যাত্রাতেই তার প্রমাণ পেলাম। 

যাই হোক, দুপুরের খাবার শেষে আমাদের পনেরো জনের দল আটলান্টিকের বুকে সাঁতার কাটতে রওয়ানা হলো। আটলান্টিকের চরে যেতেই আমার চোখ তো চড়কগাছ। হাজার হাজার মানুষ আটলান্টিকের শান্ত জলে সাঁতার কাটছে। অনেকে কড়া সূর্যের আলোর নিচে ছোট ছোট প্লাস্টিকের ছাউনিতে বিশ্রাম নিচ্ছে, বই পড়ছে অথবা তার প্রিয়জনের সাথে একান্তে গল্প জমাচ্ছে। আমার কাছে এই দৃশ্যগুলো অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।

আমরা বাংলাদেশিরা সচরাচর এইসব দৃশ্যে অভ্যস্ত নই। আমার জন্য একটু বেশি অদ্ভুত লাগার কথা আমার যে কখনো বাড়ির পাশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতও ঘুরে দেখা হয়নি! সারাদিন সাঁতার কেটে সাগর পারে কিছুটা বিশ্রাম নিলাম। বিকেলের দিকে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লে ছুটলাম ক্যাম্পিং খোঁজার উদ্দেশ্যে। কাছেই একটি ক্যাম্পিং পেয়ে গেলাম।
সবাই আসবাবপত্র নিয়ে নিজ নিজ তাঁবু মেরামতের জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এইগুলো কাপড়ের তাঁবু যাকে বলা হয় টেন্ট। লাগোসে তিনদিন অবস্থান করে চতুর্থ দিন সকালে লাগোস থেকে প্রায় একদিনের পথ পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।

সন্ধ্যার দিকে লিসবনের অদূরে ছোট্ট একটি গ্রামে আবারো তাঁবু গাড়লাম, ওখানেই রাত কাটালাম। পরদিন সকালে রাজধানী লিসবনে যাত্রার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। লিসবন ভ্রমণের জন্য আমার একটু বেশি উৎসাহ কাজ করছিলো। কারণ ওখানে অলি চাচা, গুলজার ভাই, আশিকসহ আরো অনেক পরিচিতদের বসবাস এবং অনেকদিন পর তাদের সাক্ষাতের জন্য এক্সাইটেড ছিলাম।

দুপুরের দিকে লিসবন পৌঁছলাম। লিসবনের রাস্তাঘাট, আটলান্টিক পারের চারদিকে ভ্রমণকারীদের ভিড় আর ভিড়। এখানে লন্ডন প্যারিসের মতো মানুষকে ব্যস্ত দেখাচ্ছিলো না। সবাইকে রিলাক্স মোডে আবিষ্কার করলাম। বিদেশি ভ্রমণকারীদের মধ্যে ব্রিটিশ, ফরাসি ও আমেরিকানদের ভিড় বেশি। 

আগে থেকে জানতাম লিসবনে প্রচুর বাংলাদেশিদের বসবাস। কিন্তু লিসবন যে একটি 'মিনি বাংলাদেশে' পরিণত হয়ে আছে তা কল্পনাতেই ছিলো না। লিসবনের রাস্তার দু’পাশ দিয়ে বাংলাদেশি দোকানপাট ও রেস্টুরেন্টে ঠাসা, বোঝার উপায় নেই এটা ঢাকা শহরের কোন গলি না লিসবনের। আমি প্রতিটা বাংলাদেশি দোকানে একবার করে হলেও ঢুঁ মারার চেষ্টা করেছি।

অনেকদিন হলো বাংলায় কথা বলা হয়নি, তাই নিজের দেশের মানুষদের কাছে পেয়ে সবাইকে অতি আপন মনে হলো। আমার সাথে থাকা ফরাসি বন্ধুরাও এতো বাংলাদেশিদের লিসবনে বসবাস দেখে অবাক। তাদেরও বিশ্বাস হচ্ছিলো না এটা কীভাবে সম্ভব। আমি প্রতিটা বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করায় আমার বন্ধুরা নিষেধ করেছে, তাদের যুক্তি হলো হোক না তারা বাংলাদেশি কিন্তু তারা তোমার পরিচিত না, সুতরাং অপরিচিতদের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো!

কিন্তু লিসবনের বাংলাদেশি ভাইদের ওয়েলকামিং রেসপন্স দেখে ফরাসি বন্ধুরা অভিভূত হয়েছে। বাংলাদেশি অনেক দোকানদার ভাইয়েরা আমাকে উপহার দিয়েছেন, আমার সঙ্গে থাকা বন্ধুদের জন্যও হাতের ব্রেসলেট, চশমা, টি-শার্টসহ এই রকম ছোট ছোট নানা গিফট দিতে কার্পণ্য করেননি। নিজের দেশের মানুষের প্রতি এই আন্তরিকতা ভালোবাসা দেখে আমার বিদেশি বন্ধুরা অবাক হয়েছে। তারা বলছিলো, আমাদের দেশে এইগুলো কেউ করে না, হোক না নিজ দেশি তবু অপরিচিতদের সাথে এমন আন্তরিকতা কেউ দেখায় না।

সত্যিকার অর্থে আমার বাংলাদেশি ভাইয়েরা বিদেশি বন্ধুদের কাছে আমার মাথাকে উচুঁ করেছেন, দেশকে উচুঁ ও সম্মানিত করেছেন। আমি আমার দেশের মানুষের আতিথেয়তার এই মানসিকতা নিয়ে গর্ব করি। লিসবনে তিনদিন ভ্রমণ করে কেটে গেলো। এখানেও সাগরে সাঁতার কাটলাম, কিছু কেনাকাটা করলাম, সাগরের মাছ দিয়ে পর্তুগিজ রেস্টুরেন্টে দু’বেলা খাবার খেলাম। লিসবনের স্পেশালিটি হচ্ছে সাগরের সারডিন মাছ, যা পৃথিবী জুড়ে এখান থেকে রপ্তানি করা হয়।

তিনদিন লিসবন সফর শেষে পর্তুগালের পুরাতন রাজধানী পোর্তো উদ্দেশ্যে আরো তিনদিনের জন্য রওয়ানা দিলাম। এখানেও তাঁবু করলাম। পাশের শপিং মল থেকে তিনদিনের বাজার করে নিলাম। রাতের খাবার শেষে ক্যাম্পিংয়ে একটু ঘুরে ঘুরে দেখলাম, বেশির ভাগই আমাদের মতো ছাত্র যারা সামারের ছুটিতে কিছুদিন পর্তুগালে কাটানোর জন্য দলবেঁধে এসেছে।

পরদিন সকালে পর্তুগালের সবচেয়ে পুরাতন শহর পরতু ঘুরে দেখলাম। পরতুর রাস্তাঘাট, পুরাতন দালান বাড়ি এবং গির্জাগুলো এই বুড়ো এবং পুরাতন শহরের সাক্ষ্য দিচ্ছিলো। পরতুতেও লিসবনের মত বাংলাদেশি দোকানপাট ভরপুর। বাংলাদেশি ভাইদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম এখানে তারা বেশ ভালোই আছেন। অন্যান্য দেশের মতো সন্ত্রাসী হামলার ভয় নিয়ে পর্তুগালে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য করতে হয় না। রোজগার কিছুটা কম হলেও তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও আরামের জীবন পেয়েছেন। পুরতুতে অনেক পুরোনো পুরোনো গির্জা দেখতে গেলাম। ঢাকাকে যদি মসজিদের শহর বলা হয় তাহলে পরতুকেও গির্জার শহর বলা যায়। ঘুরলাম সাগরের বিভিন্ন রকমের প্রাণী দিয়ে সাজিয়ে রাখা ইয়া বড়ো অ্যাকুরিয়াম। লাগোস ও লিসবনের মত এখানেও নিয়মিত রুটিনে ছিলো সাগরে সাঁতার কাটা, আইসক্রিম খাওয়া। 
ভ্রমণের শেষদিন সবার মন খারাপ। কারো ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। লাগোস, লিসবন ও পরতুর মায়া  পেছন থেকে টেনে ধরেছে। এই মায়া একটু বেশি যেন আমাকে টেনে ধরেছে। এখানকার সাধারণ জীবন যাপন, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট, নদী, সাগর সবকিছুতে যে আমি বাংলাদেশের ছায়া খুঁজে পেয়েছি! আর দেশি মানুষের এতো ভিড় আমি ফ্রান্সের যে শহরে থাকি ওখানে নেই বললে চলে। তবুও তো চলে যেতে হবে।

নির্ধারিত সময়ের বেশি থাকার পরিকল্পনা নিয়েও আমরা আসিনি। অবশেষে রুপসী পর্তুগালের মায়া ভালোবাসাকে পেছনে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। তবে রূপসীকে কথা দিয়ে এসেছি যখনই সময় পাবো তাকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখতে, তার আটলান্টিকের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলা শান্তির নহর থেকে আরেকটু শান্তি পেতে আবার আসবো! হয়তো বারবার আসবো। আমি যে এ রূপসীর প্রেমে পড়েছি!

লেখক: প্রবাসী ছাত্র, মন্টিপলিজ ইউনিভার্সিটি, ফ্রান্স

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!