এই দেশটিতে লন্ডনে ক্যানারি ওয়ার্ফের মতো নেই উঁচু উঁচু ব্যবসায়িক দালান। পর্তুগালের বাতাসে নিউ ইয়র্কের মতো বড় বড় ডলারের গন্ধ পাওয়া যায় না। অথবা দুবাই কাতারের মতো মার্বেল পাথর দিয়ে খোদাই করা বুর্জ অব দুবাইয়ের মতো চোখ ধাঁধানো অট্টালিকা নেই এখানে। তবে এখানে আছে এক অকৃত্রিম ভালোবাসা, মায়ার টান যা এখানে না ঘুরে গেলে উপলব্ধি করা যাবে না।
জানি না কেনো লাগোস, লিসবন ও পর্তোতে এই অসম ভালোবাসার টান অনুভব করলাম। তা আটলান্টিকে স্রোতে ভেসে আসা পৃথিবীর সব ভালোবাসা পর্তুগালের শহরগুলোতে লেপ্টে পড়া ভালোবাসা না ইবনে বতুতার রেখে যাওয়া কোন অলৌকিক আকর্ষণ, যা তার মতো ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য পর্তুগালের জন্য।
সফরের তৃতীয় দিন দুপুরের দিকে আমরা প্রথম পর্তুগালের লাগোস শহরে ঢুকলাম। শহরে ঢুকতেই আমি আঁচ করতে পারলাম এখানকার মানুষের মাঝে অন্যান্য ধনী দেশের মানুষের মতো অস্থিরতা নেই। বাড়ি-ঘর দোকানপাটগুলো সম্পূর্ণ সাধারণ মানের তৈরি। মানুষের হাঁটা চলাচল শান্ত। ট্রেনের মধ্যেও কোন হুড়োহুড়ি নেই। দুপুরে খাবারের জন্য একটি শপিং মলে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম এখানকার জিনিসপত্রের দামও বেশ কম।
যাই হোক, দুপুরের খাবার শেষে আমাদের পনেরো জনের দল আটলান্টিকের বুকে সাঁতার কাটতে রওয়ানা হলো। আটলান্টিকের চরে যেতেই আমার চোখ তো চড়কগাছ। হাজার হাজার মানুষ আটলান্টিকের শান্ত জলে সাঁতার কাটছে। অনেকে কড়া সূর্যের আলোর নিচে ছোট ছোট প্লাস্টিকের ছাউনিতে বিশ্রাম নিচ্ছে, বই পড়ছে অথবা তার প্রিয়জনের সাথে একান্তে গল্প জমাচ্ছে। আমার কাছে এই দৃশ্যগুলো অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।
সন্ধ্যার দিকে লিসবনের অদূরে ছোট্ট একটি গ্রামে আবারো তাঁবু গাড়লাম, ওখানেই রাত কাটালাম। পরদিন সকালে রাজধানী লিসবনে যাত্রার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম। লিসবন ভ্রমণের জন্য আমার একটু বেশি উৎসাহ কাজ করছিলো। কারণ ওখানে অলি চাচা, গুলজার ভাই, আশিকসহ আরো অনেক পরিচিতদের বসবাস এবং অনেকদিন পর তাদের সাক্ষাতের জন্য এক্সাইটেড ছিলাম।
আগে থেকে জানতাম লিসবনে প্রচুর বাংলাদেশিদের বসবাস। কিন্তু লিসবন যে একটি 'মিনি বাংলাদেশে' পরিণত হয়ে আছে তা কল্পনাতেই ছিলো না। লিসবনের রাস্তার দু’পাশ দিয়ে বাংলাদেশি দোকানপাট ও রেস্টুরেন্টে ঠাসা, বোঝার উপায় নেই এটা ঢাকা শহরের কোন গলি না লিসবনের। আমি প্রতিটা বাংলাদেশি দোকানে একবার করে হলেও ঢুঁ মারার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু লিসবনের বাংলাদেশি ভাইদের ওয়েলকামিং রেসপন্স দেখে ফরাসি বন্ধুরা অভিভূত হয়েছে। বাংলাদেশি অনেক দোকানদার ভাইয়েরা আমাকে উপহার দিয়েছেন, আমার সঙ্গে থাকা বন্ধুদের জন্যও হাতের ব্রেসলেট, চশমা, টি-শার্টসহ এই রকম ছোট ছোট নানা গিফট দিতে কার্পণ্য করেননি। নিজের দেশের মানুষের প্রতি এই আন্তরিকতা ভালোবাসা দেখে আমার বিদেশি বন্ধুরা অবাক হয়েছে। তারা বলছিলো, আমাদের দেশে এইগুলো কেউ করে না, হোক না নিজ দেশি তবু অপরিচিতদের সাথে এমন আন্তরিকতা কেউ দেখায় না।
তিনদিন লিসবন সফর শেষে পর্তুগালের পুরাতন রাজধানী পোর্তো উদ্দেশ্যে আরো তিনদিনের জন্য রওয়ানা দিলাম। এখানেও তাঁবু করলাম। পাশের শপিং মল থেকে তিনদিনের বাজার করে নিলাম। রাতের খাবার শেষে ক্যাম্পিংয়ে একটু ঘুরে ঘুরে দেখলাম, বেশির ভাগই আমাদের মতো ছাত্র যারা সামারের ছুটিতে কিছুদিন পর্তুগালে কাটানোর জন্য দলবেঁধে এসেছে।
নির্ধারিত সময়ের বেশি থাকার পরিকল্পনা নিয়েও আমরা আসিনি। অবশেষে রুপসী পর্তুগালের মায়া ভালোবাসাকে পেছনে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। তবে রূপসীকে কথা দিয়ে এসেছি যখনই সময় পাবো তাকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখতে, তার আটলান্টিকের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলা শান্তির নহর থেকে আরেকটু শান্তি পেতে আবার আসবো! হয়তো বারবার আসবো। আমি যে এ রূপসীর প্রেমে পড়েছি!
লেখক: প্রবাসী ছাত্র, মন্টিপলিজ ইউনিভার্সিটি, ফ্রান্স
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |