নিউ ইয়র্কে উদীচীর মঙ্গল শোভাযাত্রা

নিউ ইয়র্কে শোভাযাত্রা করে নতুন বছরকে বরণের পাশাপাশি জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ নম্বর স্ট্রিট এবং ৩৭ অ্যাভিনিউর কর্ণারকে ‘বঙ্গবন্ধু কর্ণার’ হিসেবে ঘোষণার দীর্ঘদিনের দাবির পরিপূরক কর্মসূচি পালন করেছে যুক্তরাষ্ট্র উদীচী।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2017, 04:10 PM
Updated : 29 April 2017, 04:34 AM

রোববার সকাল সাড়ে ১১টায় ছিল চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রার আদলে জ্যাকসন হাইটসের সড়ক প্রদক্ষিণের সময় ৩৭ নম্বর অ্যাভিনিউর ওই কোণায় দাঁড়িয়ে সমবেত কন্ঠে বৈশাখ বরণের সঙ্গীতগুলো পরিবেশন করা হয়।

উদীচীর বর্ণিল শোভাযাত্রার আমেজ গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বৈশাখ বরণে প্রবাস প্রজন্ম এবং অভিভাবক সমন্বয়ে ৬০ থেকে ৬২টি রকমের খাবার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উদীচী দৃষ্টিনন্দন কর্মসূচি পালন করলেও এবারের অনুষ্ঠানের আমেজ অতীতের অনুষ্ঠানগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করছেন প্রবাসীরা।

শোভাযাত্রায় ছিলো বিরাট এক বাঘের প্রতিকৃতি। সাথে নানা জীবজন্তুর মুখোশ। বকসহ নানা পাখির ছবি ও প্ল্যাকার্ডে শোভিত নানা স্লোগান।

এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ‘বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হউন’, ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে’, ‘জীবন আনন্দে পূর্ণ হউক’ ইত্যাদি। শোভাযাত্রায় ছিলেন ১৯ মাস বয়সী শিশু প্রাঞ্জল থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ প্রবাসী বাংলাদেশিরাও।

শোভাযাত্রাটি শুরু হয় ৩৪ অ্যাভিনিউর উদীচী স্কুলের কোণা থেকে। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ মিছিল। মিছিলের সারিতে চারজন করে লাইন। সব সামনে ছিল ছয়টি ছোট্ট মেয়ের গলায় শুভ নববর্ষের ছয়টি শোভিত একটি লাইন। তারপর- 'এসো হে বৈশাখ' ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নামাঙ্কিত ব্যানার। তাতে ছিল বাংলাদেশের গ্রাম বাংলা, আউল-বাউল ও বাঙালি নৃত্যের দৃশ্য।

এরপরে ছিল শিশুদের লাইন, যাদের সবাই বৈশাখী পোশাকে সজ্জিত ছিল। তারপর লাল শাড়ি পরিহিত ৭/৮ জনের একদল নৃত্য শিল্পী। পেছনে ছিল জীবন বিশ্বাসের পরিচালনায় উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর গানের স্কোয়াড। তারপরে পর্যায়ক্রমে মহিলা ও পুরুষদের চারজন করে লাইন।

শোভাযাত্রায় ছিলেন উদীচীর শুভানুধ্যায়ী প্রবাসের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রবাসীরা। সাংবাদিক ও টিভির আলোকচিত্র শিল্পীরা। ছিলো ঢাকের বাদক। ছিল পহেলা বৈশাখ নববর্ষকে আবাহন ও উদীচীর মঙ্গল কামনা করে মুহুর্মূহু শ্লোগান।

ঢাকের শব্দ আর শ্লোগানে পহেলা বৈশাখের আমেজকে আরো গভীর থেকে গভীরতর করে তুলছিলো। সামনে দিক নির্দেশনা দিয়ে চলছিলো একটি পুলিশের গাড়ি। পেছনে শান্ত, ধীর, শৃঙ্খলাবদ্ধ শোভাযাত্রা।  মিছিল যখন এগোতে থাকলে আশপাশের জনগণ হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলো। ছবি তুলছিল।

৩৪ এভিনিউ থেকে ৭৩ স্ট্রিট হয়ে শোভাযাত্রাটি ভাবগম্ভীর পরিবেশে এগিয়ে ৩৭ অ্যাভিনিউতে পৌঁছে। সেখানে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী পহেলা বৈশাখের গান পরিবেশন করে।

আবার ৩৭ এভিনিউ হয়ে ৭৪ স্ট্রীটে ফিরে আসার পথে মোড় নেয়। সেই মোড়ে একইভাবে আবার স্ট্রিটের ওপরে দাঁড়িয়ে গান পরিবেশন করা হয়।

আবার ধীর অথচ স্বাভাবিক গতিতে শোভাযাত্রা এগিয়ে যায় মূল অনুষ্ঠানের গন্তব্যস্থল উদীচী স্কুলে।

স্কুলে প্রবেশের আগে উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জীবন বিশ্বাস সবার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন।

তিনি সকলকে শুভনববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘দেশে মৌলবাদের সাথে সরকারের আপস সখ্যতার’ তীব্র নিন্দা জানান।

তিনি বলেন, "সরকার ভোটের রাজনীতির নেশায় স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র বিসর্জন দিয়ে বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে সঙ্কোচিত করে মৌলবাদের সাথে আপস করছে। জনগণকে সরকারের এই অপরিনামদর্শী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে।"

ঠিক সাড়ে ১২টায় উদ্বোধন করা হয় পিঠা অনুষ্ঠান। তারপর ঠিক দেড়টায় শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

উদ্বোধন করেন উদীচীর সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি  ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। পাশে ছিলেন কনসাল জেনারেল জনাব শামীম আহসান। তারা দুজনেই উদীচী এবং উপস্থিত সকলকে নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতে জীবন বিশ্বাসের পরিচালনায় 'এসো হে বৈশাখ' ও উদীচী সংগঠনের নিজস্ব গানসহ চারটি গান পরিবেশিত হয়।

এতে স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রী ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সমবেত ছিল। তারপর পর্যায়ক্রমে ছিল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গান, তলবার লহর, নৃত্য, শহীদ উদ্দীনের কৌতুক, বড়দের সম্মিলিত গান। ছিল ছাত্রছাত্রীদের বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতির আলোকে যেমন খুশি সাজো-এর পরিবেশনা।

সবশেষে দর্শক শ্রোতাদের বিমুগ্ধ করেছে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের মিলিত বিভিন্ন সাজে একটি কৌতুকপূর্ণ নৃত্য। তারপর জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

বিকাল ৪টায় পরিবেশিত হয় প্রতিবারের ন্যায় উদীচী পরিবারের ঘরে তৈরি ইলিশ, ভর্তা সহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার। অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে প্রায় সাড়ে ছয়শ প্রবাসী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে খাবার নেন।

মঞ্চ ও শোভাযাত্রার বাঘ, মুখোশ ও বটগাছ তৈরি করেন শিল্পী টিপু আলম। মঞ্চ সজ্জায় ছিলেন জেবু চৌধুরী ও তুষার রায়।

সহযোগিতায় ছিলেন আলীম উদ্দীন, মোহিত আচার্য সুলেখা রায়। খাবার ও অন্যান্য দায়িত্বে ছিলেন সমীর মন্ডল, অশোক রায়, মো. আলম নিউমুন, শফি চৌধুরী হারুন, মো. হারুন ও আরো অনেকে। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন ফারুক ফয়সল, সাবিনা হাই উর্বি ও জীবন বিশ্বাস। সাউন্ডে মঞ্জু।

আপ্যায়ন ও নিরাপত্তায় মোঃ এ কে সরকার। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন উদীচীর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি সুব্রত বিশ্বাস।

গান, নৃত্য, তবলাসহ বিভিন্ন অংশে অংশগ্রহনকারী শিল্পীরা হলেন-সাবিনা হাই উর্বি, সুদৃতা পাল সুলেখা, জয়ন্তী ভট্টাচার্য্য, অনামিকা মজুমদার, রাবেয়া আখতার, নাজনীন সুলতানা, সাহানা আক্তার, নুপুর, সুক্তি বিশ্বাস, মিতা দেবনাথ, সংগীতা চবক্রবতী, অমৃতা রায় মিষ্টি, দিব্য রায়, উদিতা তন্বী, তৃষা মন্ডল, স্মারনিকা চক্রাবর্তী, নাভিয়ানা চৌধুরী, সায়বা উদ্দিন, লামিয়া তালকদার রাত্রি, বাধন কর্মকার, প্রিয়াঙ্কা সরকার, এনি দাস, অন্নপূর্ণা দত্ত, নিশাত হাসান নাদিয়া হাসান রাবেয় বাসরী, দিপ্ত রায়, ইশতিয়াক সামিন, রামিসা, অর্জুন মল্লিক, অনিক মন্ডল, অনির্বাণ রায়, প্রমিত মহান আচার্য, লামিয়া তালুকদার রাত্রি, অনুপম চৌধুরী, নিশাত হাসান, সিতাব উদ্দীন, অচিন্ত্য রায়, দুর্জয় রায় সৃজয় রায়, নামিরা মালেক, নবনীতা চান্দা, নাশাত হোসাইন, মো. আদনান মাহির কাসাব, বৈভব রায়, অশোক ধর, দেবস্মিতা দেবনাথ, ফারহান মাহিন অর্ণব, প্রতীক মোদক, নুজাইমা ইশরাত সারা, রাজদীপ বণিক, রাজু হোসাইন, ফারহান খান, সিন্থিয়া আইরিণ রিয়া, তাফান্নুম বিনতে করিম নূহা, নাজমুন্নাহার কাকলী এবং মিতা দেবনাথ।

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!