লিবিয়ায় যেমন আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা

বাংলাদেশিদের জন্য লিবিয়া সব সময়ই আকর্ষণীয় একটা দেশ ছিল। কারণ লিবিয়াতে যাওয়া তুলনামূলক সহজ, উপার্জন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর চেয়ে ভালো।

মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা, লিবিয়ার ত্রিপলি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2017, 06:59 AM
Updated : 12 Feb 2017, 06:59 AM

লিবিয়াতে কাগজপত্রের বৈধতা নিয়ে খুব বেশি কড়াকড়ি নেই, পুলিশি হয়রানি নেই। সবচেয়ে বড় কথা- লিবিয়া হচ্ছে ইউরোপে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ, সস্তা এবং জনপ্রিয় রুট। কিন্তু যেখানে গৃহযুদ্ধের আগে এক লাখের মতো বাংলাদেশি লিবিয়ায় ছিলেন, যুদ্ধের পর এখন প্রায় তিরিশ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন।

লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে আন্দোলনের ষষ্ঠ বর্ষপূর্তি আসছে কয়দিন পরেই। প্রশ্ন হচ্ছে, গাদ্দাফির পতনের পাঁচ বছর পর বর্তমানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য লিবিয়া কতটুকু বাসযোগ্য?

গাদ্দাফির পতনের পর ২০১২ এবং ২০১৩ সাল ছিল লিবিয়া প্রবাসীদের জন্য স্বর্ণযুগ। দীর্ঘ সময়ের স্বৈরশাসনের অবসানে বিভিন্ন ধরনের বাধা উঠে যাওয়ায় লিবিয়ানদের ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। তার সুফল লিবিয়ানদের পাশাপাশি প্রবাসীরাও ভোগ করতে থাকেন। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়ে কয়েকগুণ। লিবিয়ান দিনারের মান কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে পৌঁছে।

পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে ২০১৪ সালে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে ইসলামিস্ট বনাম ন্যাশনালিস্টদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং পরবর্তীতে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। গৃহযুদ্ধে ত্রিপলি এয়ারপোর্ট সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। লিবিয়ার আয়ের মূল উৎস তেল উৎপাদন কমে যায়। বিশৃঙ্খলার সুযোগে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) দখলে চলে যায়।

দেশে একাধিক সরকার কার্যক্রম চালাতে থাকে। মিলিশিয়াদের দৌরাত্ম্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। প্রায় সবগুলো বিদেশি দূতাবাস লিবিয়ায় তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে মাল্টা এবং তিউনিসিয়ায় অবস্থান নেয়। অধিকাংশ কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়, যেগুলো থেকে যায় সেগুলোও অর্থনীতির শোচনীয় অবস্থার কারণে কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি।

লিবিয়াতে এই মুহূর্তে কর্মসংস্থানের সংকট প্রকট। বিদেশি কোম্পানি প্রায় নেই বললেই চলে। লোকাল কোম্পানিগুলোও অধিকাংশই ছয় মাস, এক বছর ধরে বেতন দিতে পারছে না। যারা বিভিন্ন দোকান-পাট, ফার্মেসি, পেট্রোল-পাম্প এবং বাসাবাড়িতে কাজ করছেন, তারাই শুধু নগদ টাকা হাতে পাচ্ছেন। কিন্তু সেই টাকা দেশে পাঠানোরও কোন উপায় নেই। কারণ মানিগ্রাম, ওয়েস্টার্ন ইউনিউনসহ সব ধরনের ট্রানজেকশন সার্ভিস দুই বছর ধরে বন্ধ।

ছবি: রয়টার্স

দেশে টাকা পাঠানোর একমাত্র উপায় হুন্ডি। কিন্তু ব্ল্যাক মার্কেটে ডলারের মূল্য দিনারের চেয়ে বেড়েই চলেছে। অথচ মানুষের আয় তো বাড়েনি, বরং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ফলে অধিকাংশ অদক্ষ শ্রমিকের পক্ষে মাসে তিন’শ থেকে চার’শ দিনারের বেশি সঞ্চয় করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনভাবে দেশে পাঠাতে পারলেও মাত্র ষাট থেকে সত্তর ডলার হবে। আর এই টাকা পাঠানোও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। টাকা পাঠানোর নাম করে তা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ।

বেনগাজি, সিরত, দারনাসহ লিবিয়ার বিভিন্ন অংশে আইএস এবং আল-কায়েদাপন্থী গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরে যুদ্ধ চললেও প্রবাসীদের উপর সেগুলোর খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথেই সাধারণত লিবিয়ানরা ওইসব এলাকা ছেড়ে চলে যান। প্রবাসীরাও অন্য কোথাও সরে যান। এতে তাদের চাকরি ও কাজের ক্ষতি হয়। তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খুব বড় কোন সমস্যা হয় না।

প্রবাসী বাংলাদেশিরা অবশ্য ঝুঁকির মুখে থাকেন ত্রিপলির মতো বড় শহরগুলোতে। এখানে বড় ধরনের কোন যুদ্ধ নেই, কিন্তু মিলিশিয়াদের আনাগোনা আছে। নিয়মিত পুলিশ এবং সেনাবাহিনী না থাকায় এখানে মিলিশিয়ারাই সব। কিন্তু পুরো দেশে মিলিশিয়া গ্রুপগুলোর সত্যিকার সংখ্যা কত, কে বৈধ, কে অবৈধ, সেটা জানার কোন উপায় নেই।

সবার হাতে হাতে অস্ত্র। যে কোন সময় যে কোন জায়গায় অস্ত্রধারী কোন একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে যেতে পারে। অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান ফিট করা দুই-তিনটা গাড়ি বসিয়ে চেকপয়েন্ট বসিয়ে দিতে পারে। এইসব চেকপয়েন্টে প্রবাসীদের হয়রানির শিকার হওয়া নিয়মিত ব্যাপার।

রাজধানী ত্রিপলিতে প্রতিদিন অপহরণের এর ঘটনা ঘটছে। শিকার হচ্ছেন বিভিন্ন প্রবাসীরা। লিবিয়ানরা জানে, প্রবাসীরা দুই বছর ধরে দেশে টাকা পাঠাতে পারছে না। দুই বছরের সব আয়-উপার্জন তাদের ঘরেই আছে। কাজেই তাদেরকে কিডন্যাপ করলেই টাকা পাওয়া যাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশিদের কিডন্যাপ করার ক্ষেত্রে লিবিয়ান গ্যাংদের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশি দালালচক্রও জড়িত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিটা অপহরণের পর দুই-তিন হাজার দিনার মুক্তিপণ দিতে হয়। টাকা দিতে দেরি হলেই চলে নির্যাতন।

ছবি: রয়টার্স

কিডন্যাপিং এবং ছিনতাইয়ের ভয়ে দিনে-রাতে মানুষ ঘর থেকে বের হতে সাবধান থাকেন। অপরিচিত ট্যাক্সিতে চড়া যায় না, অপরিচিত জায়গায় কাজে যাওয়া যায় না। অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারেও সাবধান থাকতে হয়। ফলে যাদেরকে উপার্জনের জন্য বাইরে কাজের উপর নির্ভর করতে হয়, তারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব জায়গায় কাজ করতে পারেন না।

লিবিয়াতে বাংলাদেশিদের আসার একটা বড় কারণ হচ্ছে ইতালিযাত্রা। কিন্তু দিনে দিনে এই যাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। ইউরোপে যাওয়ার যতগুলো রুট আছে, তার মধ্যে লিবিয়া থেকে ইতালি হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই ভূমধ্যসাগরে সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা গেছে, যার অধিকাংশই লিবিয়া রুটের যাত্রী।

শুধু মৃত্যুই না, যাত্রাপথে লিবিয়ার সমুদ্রসীমায় ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটলে তাদেরকে লিবিয়াতে ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের স্থান হয় বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ পরিচালিত ডিটেনশন সেন্টারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে বারবার এসব ডিটেনশন সেন্টারের বন্দিদের মানবেতর জীবন যাপনের কাহিনী উঠে এসেছে।

সম্প্রতি সমুদ্রপথে অবৈধভাবে ইতালিতে অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে ইতালির সাথে লিবিয়া সরকারের একটা চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি অনুসারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইতালি লিবিয়ান সরকারকে অনুদান দেবে যাতে করে এসব অবৈধ অভিভাসীদেরকে লিবিয়াতেই ফেরত নিয়ে পুনর্বাসন করা যায়। কিন্তু জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গবষকরা এই চুক্তির কঠোর সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, এর ফলে এইসব অবৈধ অভিভাসীরা পুনর্বাসনের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদে ডিটেনশন সেন্টারে আটকা পড়ে থাকবে। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে যেসব বাংলাদেশি গত কয়েক বছরে অবৈধভাবে লিবিয়াতে প্রবেশ করেছেন, তারাও ঝুঁকির মুখে পড়বেন।

ছবি: রয়টার্স

গত কয়েক মাসে লিবিয়ার পরিস্থিতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় সাত মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সিরত আইএস-মুক্ত হয়েছে। বেনগাজির বড় একটা অংশ আইএস এবং আল-কায়েদাপন্থী গ্রুপগুলোর হাত থেকে মুক্ত হয়েছে। অনেকগুলো তেলক্ষেত্র পুনরায় তেল উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু সেগুলোর সুফল এখনও আসতে শুরু করেনি। অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়াতে লোক আসা নিষিদ্ধ । তবুও কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে দালালদের প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে লিবিয়াতে ঢুকছে। কিন্তু এখানে আসার পর কাজ না পাওয়া, দেশে টাকা পাঠাতে না পারা, ছিনতাই-কিডন্যাপিংয়ের শিকার হয়ে অনেকেই বড় ক্ষতি নিয়ে আবার দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই বাংলাদেশিদের উচিৎ হবে, লিবিয়ার পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত লিবিয়ার আসার ব্যাপারে আপাতত চেষ্টা না করা।

লেখক: প্রবাসী বাংলাদেশি নির্মাণ প্রকৌশলী

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!