আমরাই কেন হামলার লক্ষ্য- ক্ষোভ জাপানে

বাংলাদেশের গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় জাপানের সাত নাগরিককে হত্যার ঘটনায় দেশটিতে শোকের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভও ঝরে পড়ছে।

এস এম নাদিম মাহমুদ, জাপান থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2016, 07:28 PM
Updated : 3 July 2016, 08:02 PM

আর ঢাকায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাপানিদের ক্ষোভ আর প্রশ্নের মধ্যে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

কূটনীতিকপাড়ার ওই ক্যাফেতে শুক্রবার রাত থেকে শুরু রক্তাক্ত জিম্মি সঙ্কটের ঘটনাটি ১২ ঘণ্টা পর পরদিন সকালে অবসান হলেও সবস্তরের জাপানিরা খবর পায় স্থানীয় সময় শনিবার রাতে, স্থানীয় টেলিভিশন ও সংবাদ মাধ্যমে প্রচারের পর।

এরপর থেকেই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় জাপানিদের মাঝে; দেশটির বিভিন্ন স্থান থেকে সন্ত্রাস প্রতিরোধে সবার মধ্যে ঐক্যের দাবি জানানোর পাশাপাশি জাপান নাগরিকরা মুখে ধ্বনিত হচ্ছে ‘ডোন্ট কিল জাপানিজ’।

ঢাকায় কমান্ডো অভিযানে জিম্মি সঙ্কট অবসানের পর যে তিন বাংলাদেশি ও সাত জাপানির সঙ্গে নয় ইতালীয় ও এক ভারতীয় নাগরিকের লাশও বের করা হয়।

নিহত জাপানিরা ঢাকার বহু প্রতীক্ষিত মেট্রো রেল প্রকল্পের সমীক্ষক ছিলেন। তারা হলেন- কোইও ওগাসাওয়ারা, (কাতাহিরা অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্টারন্যাশনাল), হিরোশি তানাকা (অরিয়েন্টাল কনসালটেন্টস গ্লোবাল), নোবুহিরো কুরোসাকি (অরিয়েন্টাল কনসালটেন্টস গ্লোবাল), হিদেকি হাশিমতো (অরিয়েন্টাল কনসালটেন্টস গ্লোবাল), ওকামুরা মাকোতো (আলমেক করপ), ইউকো সাকাই (আলমেক করপ), শিমোদায়রা রুই (আলমেক করপ)।

তাদের নৃশংস হত্যার ঘটনায় জাপানের গণমাধ্যমে নিহতদের পরিবারের সদস্য, তারা যে কোম্পানির হয়ে কাজ করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন সেই কোম্পানির কর্মকর্তা ও সাধারণ নাগরিকরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

এছাড়া রোববার দেশটির কয়েকটি স্থান ঘুরে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া পায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমও।

স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৮টায় ওসাকা শহরের একটি ট্রেনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় পঞ্চাশের কোঠায় পা রাখা ইয়ামাদা সানরির সঙ্গে।

নিহতদের স্মরণে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন

রোববারের দৈনিক পত্রিকায় হত্যাকাণ্ডের খবর জানা ইয়ামাদা বলেন, “শনিবার তো পত্রিকায় কোনো খবর পাইনি। আর সারাদিন ব্যস্ত থাকায় টেলিভিশনই দেখা হয়নি। আজ সকালে স্টেশনে যখন পত্রিকা কিনলাম, তখন শীর্ষ সংবাদে বাংলাদেশে ‘সাত জাপানি হত্যার’ খবর দেখে চমকে উঠেছি।

“এটা মর্মান্তিক ও অমানবিক হত্যাকাণ্ড। আমি জানি না কেন তারা তাদেরকে হত্যা করেছে, তবে ‘নিহনজিন (জাপানিজ) হিসেবে গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, অন্যের হাতে খুন হব- এমন মানুষ আমরা নই।”

কিয়োবাশি এলাকার হারুরু মিয়ামি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‍“যারা আপনাদের উন্নয়ন করতে গেল, তাদেরকেই হত্যা করলেন? অদ্ভুত চিন্তা শক্তি আপনাদের।

“আপনি কোথায় দেখাতে পারবেন যে, জাপানিরা অন্যায় করছে, কারও ক্রোধের বশবর্তী হচ্ছে, অথচ বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হলো এই নিরীহ জাপানিরা। সন্ত্রাস বিশ্বের সর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্ত তাই বলে বার বার আমরা কেন টার্গেট হব?”

বাংলাদেশে এর আগে গত বছর জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এবারের মতো সেবারও আইএসের নামে দায় স্বীকারের বার্তার খবর আসে গণমাধ্যমে।

২০১৩ সালে নাইজেরিয়ায় ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের হাতে ১০ জাপানি নিহত হয়েছিল। ওই সময় পুরো দেশ জুড়ে বিক্ষোভ হলেও এবার বাংলাদেশে সাত জাপানি খুন হওয়ার পর কোনো বিক্ষোভ হয়নি।

তবে দেশের বাইরে কাজ করা জাপানিদের যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে ক্ষোভের সুরে সরকারের প্রতি রাগ ঝাড়লেন হিয়াতু কিনওয়াকা।

“গত কয়েক বছর ধরেই জাপানিরা জঙ্গিদের টার্গেট হচ্ছে, এরপরও আমাদের সরকার (শিনজো আবে) কেন সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নেন না? যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা কি শুধু জাপানকে ভালবাসে নাকি বাংলাদেশকেও ভালোবেসে সেখানে চাকরি করছে?

“বাংলাদেশের উচিত হবে, সব জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, ধর্মের আলোকে নয়… ডোন্ট কিল জাপানিজ।”

জঙ্গি হামলার নিহত মাকতো ওকামুরার স্বপ্ন ছিল আগামী বছরই বিয়ে করার; আর এই জন্য অর্থ যোগাড়ের উদ্দেশ্যে জাইকার অধীনে বাংলাদেশে চাকরি নেন বলে জানান তার বাবা কমোকুচি ওকামুরা।

চিবা প্রদেশের এই বাসিন্দা বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফোন করে মাকতো নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে। এই শোক সহ্য করার কোনো ওষুধই আমার জানা নেই।

খুব অমায়িক ও পরিশ্রমী বত্রিশ বছরের মাকতো, ছোট বেলায় থেকে সে অত্যন্ত মেধাবী ছিল। আর প্রকৌশল পাশ করার পর জাইকাতে চাকরি নেয়। মাকতো ঢাকার ট্রাফিক উন্নয়নে কাজ করছিলেন বলে জানান তার বাবা।

নিহত হিরোশি তানাকার বড় ভাই তাকাশি তানাকা বলেন, “এই শোক সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এইভাবে আমার ছোট ভাইকে হারাতে হবে তা ভাবতে পারছি না। এই সন্ত্রাসীদের কি কোনো পরিবার নেই? তারা কি পরিবারের সদস্যেদের জ্বালা বুঝে না?”

ঢাকার ক্যাফেতে হামলায় নিহত জাপানিদের মধ্য তিনজন টোকিও ভিত্তিক অরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট কোম্পানির হয়ে কাজ করতেন।

কোম্পানিটির প্রেসিডেন্ট ইইজি ইয়োনেজায়া রোববার স্থানীয় সময় রাত ৮টায় এক সংবাদ সম্মলনে এসে বলেন, “আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, বাকরুদ্ধ ও হতাশাগ্রস্ত। আমাদের কোম্পানির সবচেয়ে বর্ষীয়ান একজন প্রকৌশলীকে আমরা হারিয়েছি।”

এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয় মন্তব্য করে নিহতের পরিবারের সদস্যেদের কাছে ক্ষমা চান কোম্পানিটির প্রেসিডেন্ট।

হলি আর্টিজান বেকারির সামনে নিহতদের স্মরণে ফুল

প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে রোববার এক বিবৃতিতে নিহতের আত্বার প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন, “এটি আমাদের কাছে পুরোটাই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ছিল, যা আমি এখনো মেনে নিতে পারছি না; আমি বাকরুদ্ধ।”

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী সেইজি কিহারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন জানিয়ে আবে বলেন, “তিনি (কিহারা) নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা করবেন। এছাড়া আমরা ইতোমধ্যে জাপান থেকে বিশেষ এয়ারক্রাফট নিহতদের পরিবারের জন্য পাঠিয়েছি।”

এদিকে রোববার সকালে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সির (জাইকা) পক্ষ থেকে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে স্মরণ করা হয় নিহতদের।

জাইকার প্রেসিডেন্ট শিনিচি কিতাওকা নিহতদের আত্মার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, “তারা সবাই ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নয়নে কাজ করেছিল, এটা দুঃখজনক ঘটনা। কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন রাতে বাইরে বের না হয়।

বিকালে জাপানের সংসদের ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের’ জরুরি বৈঠক হয়। সেখান থেকেও সন্ত্রাস দমনে জাপানের সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানানো হয়েছে।

উৎকণ্ঠায় প্রবাসীরা

গত বছর রংপুরে কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের পর এবার সাত জাপানি জঙ্গিদের হাতে নিহত হওয়ার খবর শনিবার রাত থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর বেশ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। জাপানিদের কাছে জবাবদিহিতার মধ্যেও পড়ছেন অনেকে।

টোকিওতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসা লেখক প্রবীর বিকাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছুক্ষণ আগে আশিঊর্ধ্ব পরিচিত এক জাপানি নারী ফোন করে গুলশানের ঘটনার কথা জানতে চাইলেন।বাংলাদেশকে তিনি কতখানি ভালোবাসেন… যে কারণে দুশ্চিন্তা থেকে ফোন করেছেন।

“গতকালও একাধিক জাপানি বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে ফোন পেয়েছি। প্রবাসী বন্ধুরা তো করেছেই। নিজের ঘরে জাপানি স্ত্রী, সেও হতাশা ব্যক্ত করেছে।”

সায়েম সা’দত নামের এক চাকরিজীবী  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজ সকালে অফিসের এক কর্মকর্তা টেলিফোন করে বাংলাদেশে কেন জঙ্গি তৎপরতা চলছে, তার ব্যাখা চেয়েছে।

“কিন্তু আমি তো এর ব্যাখ্যা দিলে দেশের প্রতি অন্যায় হয়ে যাবে। তাই কৌশলে বললাম, যারা সন্ত্রাসী তারা পৃথিবীর সব জায়গায় সন্ত্রাসী। আইন-শৃঙ্খলার শীতলতার সুযোগে তারা এই হামলা করেছে।”

সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে এই সংকট মোকাবেলার আহ্বান জানান তিনি।

জাপানিদের প্রশ্নের মুখে পড়ার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে হিরোশিমার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিতে জুবায়ের আলমের মধ্যেও।

জুবায়ের বলেন, “আজ রোববার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি, তবে আগামীকাল সকালে যে কিভাবে ল্যাবমেটদের প্রশ্নের উত্তর দেব… তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। দেশে একটি হত্যাকাণ্ড প্রবাসীদের মনে কি পরিমাণ আঘাত হানে, তা আমরা বুঝছি। ”

সরকারকে জঙ্গি নির্মূলে আরও বেশি আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।