সন্ত্রাসী হামলার দুই দিন পর রোববার চিরচেনা প্যারিসের দৃশ্যপট যেন ছিল ‘অচেনা’।
Published : 19 Nov 2015, 06:42 PM
প্যারিসে বাংলাদেশিদের মধ্যে শঙ্কা, অস্বস্তি
সন্ত্রস্ত প্যারিসে 'অসহায়' শিল্পী শাহাবুদ্দিনের কথা
দেশে বিনিয়োগ করুন: প্রবাসীদেরকে প্রতিমন্ত্রী
ফ্রান্সে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান, একাংশের বয়কট
প্যারিসে বাংলাদেশি শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শনী
১৩ নভেম্বর ফ্রান্স জার্মানির প্রীতি ফুটবল ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল প্যারিস শহরে সন্ত্রাসী হামলার খবর। খানিকটা ‘অবিশ্বাসবোধ’ নিয়ে ফরাসি ভাষায় বোঝার চেষ্টা করছিলাম কি ঘটেছে।
খেলায় ফ্রান্স ২-০ গোলে ম্যাচ জিতলেও ম্যাচ পরবর্তী খেলার বিশ্লেষণ, পুরস্কার বিতরণ, দর্শকদের বিজয়োল্লাসের কোন মুহুর্ত আর টেলিভিশনের প্রচার না দেখে মনে হলো সত্যি প্যারিসের বুকে কোন অশুভ তাণ্ডব চলছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় ভেসে আসতে লাগল ঘটে যাওয়া নির্মমতার চিত্র এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা। যা দেখে মনে হচ্ছিল ‘রোমাঞ্চোকর’ এই নগরী যেন পরিণত হয়েছে ‘রনক্ষেত্রে’। হতবাক আর অসহায়ভাবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছিলাম গুরত্বপূর্ণ এবং জনবহুল এলাকাগুলোতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুসংখ্যা বাড়তে থাকার খবর।
আমি বাস করি প্যারিসের অন্যতম একটি জনবহুল পর্যটন স্থল ‘মনমাদ’র কাছে। এখানে এমনিতেই সবসময় আইন শৃংখলা বাহিনীর বাড়তি নিরাপত্তা থাকে। তবে বিদ্রূপ ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর অফিসে হামলার পর থেকে এখানে সেনা সদস্যের ক্যাম্প স্থাপন করে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়।
এই ঘটনার পরে আরও অনেক কিছুই ঘটার আশংকা ছিল প্যারিসবাসীর মনে।তাছাড়া জরুরি অবস্থা জারির কারণে বাইরে না বের হয়ে টিভি পর্দায় চোখ রেখেই সারা দিন কাটিয়ে দিলাম গৃহবন্দি হয়ে।
ঘটনার একদিন পর রোববার প্যারিসে জনমনের আতংক কিছুটা স্বাভাবিক হতে থাকে।
স্বজন হারানো শোকার্তরা এবং শান্তিকামী শত শত জনতা রিপাবলিক চত্বরসহ তাণ্ডব ঘটে যাওয়া স্থানগুলোতে নিহতদের স্বরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ দিতে বাইরে বের হয়েছে।
আমিও বিকাল পাঁচটার দিকে আমার কন্যা মিশেলকে নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম শোকার্ত প্যারিসের বাস্তবরূপ দেখার জন্য। ঘর থেকে বেরিয়েই ‘মনমাদে’ দেখা মিলল পুলিশের বিশেষ ফোর্স জনদারমোরির সতর্ক প্রহরা। যেন প্রতি মুহুর্তেই প্রহরীর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সন্ত্রাসীর বক্ষ ভেদ করার জন্য প্রস্তুত। পর্যটকদের আনাগোনা ও পথশিল্পীদের সংগীত মুর্ছনায় মুখরিত প্রাণোচ্ছল এই এলাকাটি যেন আইন শৃংখলাবাহিনীর সতর্ক প্রহরায় যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ নিয়েছে।
অ্যানভার্স থেকে বাসে চড়ে রওনা দিলাম আইফেল টাওয়ারের উদ্দেশ্যে। রোববারে সাপ্তাহিক ছুটির কারণে এখানে গণপরিবহনে সাধারণত ভিড় কম থাকে।
সপ্তাহের ছুটির দিন প্রতি শনি-রোববারে এখানকার পানশালাগুলো আড্ডায় সরগরম থাকে। কিন্ত এই দিনে চেনা প্যারিসকে একেবারেই অচেনা মনে হচ্ছিল। অধিকাংশ রেস্তোঁরাই বন্ধ, চলার পথে দু চারটি যা চোখে পড়ল তাতেও ভেতরের মৃদমন্দা আলোয় দেখতে পেলাম অল্পকিছু মানুষের আনাগোনা।
আইফেল টাওয়ারে পৌঁছানোর পর দেখলাম টাওয়ারের সামনে পানির ফোয়ারাগুলো আগের মতোই ক্ষীপ্র গতিতে জলের ধারা প্রবাহিত করছে কিন্তু এই সৌন্দর্য উপভোগের জন্য সৌন্দর্য পিপাসুদের ভিড় কম। নিরাপত্তাজনিত কারণে আইফেল টাওয়ারের বিরামহীন ছুটে চলা লিফট গুলোকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবসর দেওয়া হয়েছে। সেন নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো প্রমোদতরীগুলো ভ্রমনার্থীদের অভাবে নিজ নিজ ঘাটে নোঙ্গড় করে আছে।
বাসে ফেরার পথে চোখে পড়ল প্যারিসের জনপ্রিয় এ্যাভিনিউ ও অভিজাত এলাকাগুলোতে ক্রিসমাসেএবং নববর্ষ উদযাপনের বাহারি আলোকসজ্জার বৈচিত্রময় প্রতিকৃতিগুলো।
রাস্তার পাশ দিয়ে অবস্থান নিয়ে উৎসবের আগমনের আনন্দ দেবার জন্য আলো ক্রমাগত জ্বলছে নিভছে কিন্তু বিষাদের এমন দিনে যেন তার সৌন্দর্য যেন ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে।
আর তারুণ্যের আড্ডাস্থল অপেরাকে মনে হলো নির্ঝুম নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া কোন এক যায়গা।
এই ‘রোমান্টিক’ নগরের কর্মচাঞ্চল্যতা ফিরে এলেও জনমনে রয়েছে সংশয়। খুব দ্রুতই হয়তো প্যারিস এই শংকা কাটিয়ে আবার জেগে উঠবে তিলোত্তমা স্বরূপে।
প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা সরাসরি আমাদের জানান। নাম, ঠিকানা ও সংশ্লিষ্ট ছবিসহ লেখা পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায় [email protected]