খালেদাকে পার করতে হাসিনার উদাহরণ

জিয়া এতিমখানা দুর্নীতি মামলা বাতিলের শুনানিতে শেখ হাসিনার একটি মামলা বাতিলের নজির তুলে ধরলেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2014, 01:23 PM
Updated : 19 Nov 2014, 01:27 PM

বুধবার প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে বিএনপি চেয়ারপারসনের আপিল আবেদনের এই শুনানি হয়।

বিচারিক আদালতে অভিযোগ আমলে নেওয়া চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে করা আবেদন তিন বছর আগে খারিজের পর আপিল বিভাগে আসেন খালেদা। সোমবার এর শুনানি শুরু হয়।  

তৃতীয় দিনের শুনানিতে আসামি পক্ষের আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, “এই মামলায় কোনো এভিডেন্সে খালেদা জিয়ার স্বাক্ষর নেই। অভিযোগপত্র থেকেই প্রতীয়মান হয়, এতে তার কোনো ভূমিকা নেই।

“অর্থ আত্মসাতের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সেই টাকা আত্মসাতের পর্যায়ে যায়নি। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলার অভিযোগ আমলে নেওয়ার মতো কোনো উপাদান ছিল না।”

এক পর্যায়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মামলা বাতিলের কথা উল্লেখ করে জয়নুল বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মামলা আপনারা কোয়াশ করে দিলেন। অথচ খালেদা জিয়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী।”

এরপর এই মামলার বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য দেবেন জানিয়ে শুনানি আপাতত শেষ করতে চান জয়নুল।

তিনি বলেন, “খালেদা জিয়ার মামলায় হাই কোর্ট নানা মামলার রেফারেন্স দিয়েছে। কিন্তু এই মামলাটি (শেখ হাসিনার) দেখেনি। এই মামলার রায়ের কপি নিয়ে এসেছি। পরে দিব।”

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “ঠিক আছে। যুক্তি পরে দেন। কিন্তু সাইটেশনটা থাকলে দিয়ে যান।”

“আছে, কিন্তু এখনই দিয়ে যাব,” জয়নুল জানতে চাইলে প্রধান বিচারপতি হেসে বলেন, “আপনি এত কৃপণ কেন? দিয়ে যান, দিয়ে যান।”

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল তখন অনুলিপিগুলো দেন এবং হেসে হেসে বলেন, “আপনাদেরকে কী দিয়ে যে সন্তুষ্ট করব, মাই লর্ড।”

এ সময় বেঞ্চের অন্যতম বিচারক বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া হেসে বলেন, “আইন দিয়ে।”

জয়নুল বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলায় এত বড় একটা রায় হয়ে গেল। অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন বা সরকার সেটাকে আপনাদের পর্যন্ত (আপিল বিভাগ) নিয়ে নিয়েই এল না!

“আমাদের বেলায় (হাই কোর্ট) বলল, অনুমোদন ঠিক আছে। একবার নিলেই হয়। আর তাদের বেলায় সেটা হল না। আপনাদের কাছে আসলেতো আপনারা নির্দেশনা দিতে পারতেন।”

“এখন আমরা আপনাদের আসলাম। বিষয়টা আপনাদের কাছে বললাম, যেন পার পেতে পারি।”

এ সময় বিচারপতি ওয়াহহাব মিয়া বলেন, “সেই মামলা আমাদের কাছে তো আসে নাই।”

জয়নুল বলেন, “যাই হোক, আমরা এসেছি। আমরা আশা করি, আপনারা যা বলেছেন, ফ্রেশ মন নিয়ে বলেছেন, জুডিশিয়াল মন নিয়েই বলেছেন।”

জয়নুল এতিমখানা মামলার অপরাধ আমলে নেওয়া অবৈধ হয়েছে দাবি করে তার ওপর শুনানি করেন।

এরপর মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন।

খুরশীদ আলম বলেন, “খালেদা জিয়ার মামলায় হাই কোর্ট আপিল বিভাগের রায়কে উদ্ধৃত করেছে। সেখানে হাই কোর্টের অপর এক বেঞ্চের (শেখ হাসিনার মামলার বেঞ্চ) রায় মানা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু আপিল বিভাগের রায় মানা দরকার ছিল। তারা সেটাই করেছেন। এখানে ভুলটা কোথায় হয়েছে?

“জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের কথা বলে টাকা নিয়ে যাওয়া হল, অথচ কাগজপত্র ছাড়া এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এই ট্রাস্টের ঠিকানায় ৬ নম্বর মইনুল রোডের বাড়ি কথা বলা হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে এই ট্রাস্টের কোনো সাইনবোর্ড-ব্যানার পাওয়া যায় নাই।”

“এই ট্রাস্টে যারা রয়েছেন, তারা খালেদার জিয়ার পুত্র স্বজন। যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে, সেখানে তারেক-কোকোর সঙ্গে তিনিও থাকতেন। তাই তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক উপাদান পাওয়া গেছে,” দাবি করেন দুদকের আইনজীবী।

ফাইল ছবি

এই মামলায় অভিযোগ গঠন হয়ে গেছে বলে তা আমলে নেওয়ার বিষয়ে শুনানি এখন হতে পারে না বলে দাবি করেন তিনি।

এ সময় এক বিচারক বলেন, “উনারা (আসামি পক্ষ) তাদের সেই কেসেও পুরো প্রসেডিংকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাই শুনানি চলতে পারে।”

বিরতির পর শুনানিতে বক্তব্য রাখেন খালেদার অন্য আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী। তিনি খালেদার মামলায় অভিযোগ গঠনের বৈধতার প্রশ্ন নিয়ে শুনানি করেন।

তিনি বলেন, কোনো মামলায় অভিযোগ গঠন করতে হলে ২৪১ (এ) ধারা অনুসারে সব রেকর্ড, তথ্য প্রমাণ পর্যালোচনা করে বিচারককে এই মর্মে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, এই ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মতো উপাদান রয়েছে। এরপর তিনি অভিযোগ গঠন করতে পারবেন।

“এই পর্যালোচনা ফর্মালিটি নয়। প্রকৃত অর্থেই করে দেখাতে হবে।”

“অভিযোগ গঠনকারী (খালেদার মামলার) বিচারক ওই দিনই প্রথম এজলাসে এসে অভিযোগ গঠন করেছেন। ৫০০ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট ১০ মিনিটে পর্যালোচনা কর সম্ভব নয়।”

“১০ মিনিটে ৫০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা সুপারম্যান হলেও কি পারবে? আপনাদের এরকম ডকুমেন্ট যদি একটি অর্ডার পাস করতে বলি, যদি পারেন, হ্যাটস অফ।”

শুনানির পর আদালত বৃহস্পতিবার পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছে।

আদালতে খালেদার আইনজীবীদের মধ্যে আরো ছিলেন মো. বদরুদ্দোজা বাদল, রাগিব রউফ চৌধুরী, এহসানুর রহমান প্রমুখ।

রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও উপস্থিত ছিলেন।

এই দুই মামলায় বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়া (ফাইল ছবি)

জিয়া এতিমখানা ও দাতব্য ট্রাস্টের দুটি মামলা বর্তমানে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ বাসুদেব রায়ের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ রয়েছে ২৪ নভেম্বর।

এই বিচারকের নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেও সর্বোচ্চ আদালতে এসেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন, তবে তার আবেদন নাকচ হয়ে যায়।

এছাড়া দাতব্য ট্রাস্ট ও এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তার আবেদনও গত ২৩ এপ্রিল হাই কোর্ট খারিজ করে দেয়। এরপর তিনি আপিল বিভাগে আসেন।

এতিমখানা মামলায় অভিযোগ আমলে নেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদার আবেদন ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্টে খারিজ হয়েছিল। এরপর করা তার আপিলের আবেদন সম্প্রতি কয়েকদফা কার্যতালিকায় আসার পর সোমবার শুনানি শুরু হয়।

২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় করা এই মামলায় এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।

তারেক রহমান উচ্চ আদালতের জামিনে গত ছয় বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আছেন জামিনে। বাকি দুজন পলাতক।

জিয়া দাতব্য ট্রাস্টের মামলাটি হয় ২০১১ সালের ৮ অগাস্ট। তেজগাঁও থানায় করা এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

এদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু হতেই পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও রয়েছে। খালেদাসহ বাকি দুই আসামি জামিনে রয়েছেন।