সোমবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় বক্তব্যে বিএনপি চেয়ারপারসনকে এই পরামর্শ দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
৫ জানুয়ারির ভোট বর্জনের পর বিএনপি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য সংলাপের দাবি জানিয়ে এলেও শেখ হাসিনা তা প্রত্যাখ্যান করে আসছেন।
ঠিক এক মাস আগে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, খুনি, ধর্ষক, লুটেরাদের সঙ্গে সংলাপ করার মতো দৈন্য দশায় সরকার পড়েনি।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে তিনি বলেন, “আমি বিএনপি নেত্রীকে বলব, জনগণকে নিয়ে আন্দোলন করেন ভালো কথা। কিন্তু, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী- তাদের সঙ্গ ছাড়তে হবে। এই মাটিতে তাদের ঠাঁই হবে না।”
বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত। তাদের ছেড়ে আসতে নির্বাচনের আগেও খালেদার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন হাসিনা।
বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “ওনার (খালেদা জিয়া) অবস্থা এমন- সাপ যদি ব্যাঙ খেলে গলায় ফেঁসে যায়; না পারে গিলতে, না পারে চলতে। ওনার কাছে জামাত হয়ে গেছে সাপের ব্যাঙ গেলার মতো অবস্থা। কিছু বলতেও পারছেন না।”
জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সরকারে স্বাধীনতাবিরোধীদের স্থান দেওয়ার ঘটনাগুলো তুলে ধরে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দল’ হিসেবে বিএনপির দাবি তোলা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন হাসিনা।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধী আব্দূল আলিমকে মন্ত্রী করেন এবং জাতিসংঘে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো, সেই শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “নিজের স্বামীকে তো স্বাধীনতার ঘোষক ঘোষক বলে গলা শুকিয়েছেন। যদি স্বাধীনতা ঘোষকই হবে- তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের কিভাবে মন্ত্রী বানায়? যদি স্বাধীনতার ঘোষকই হবে, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে নিয়ে এসে কেন বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করলেন?”
যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদকে মন্ত্রী করা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের দণ্ডের বিরুদ্ধে জামায়াতের হরতালের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজকে জামাত হরতাল দেয়, কেন? তারা যখন মানুষ খুন করেছিল, মা-বোনের ইজ্জত লুটেছিল, এদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছিল- সেসময় মনে ছিল না?
“তাহলে পাকিস্তানে চলে যাওয়াই উচিত ছিল। বাংলার মাটি কলুষিত করা কেন?”
জনগণকে দেওয়া ওয়াদা অনুযায়ী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিটি রায় আওয়ামী লীগ সরকার বাস্তবায়ন করবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
‘অবৈধ বলে সব অবৈধ দেখেন’
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যায়িত করে বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “অবৈধ পন্থায় যে দলের জন্ম, তারা সব কিছু অবৈধই দেখবে।”
“পাঁচই জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে। ৪০ ভাগ মানুষ ভোট দিয়েছে। জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছে,” বলেন ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া শেখ হাসিনা।
বিএনপির বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে সংসদ সদস্যদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে খালেদা জিয়া বলে আসছেন, ৫ জানুয়ারি কোনও ভোট হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমেরিকায় কংগ্রেস নির্বাচনে ২৫ ভাগ সিট বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হয়েছে। তাহলে কি উনি (খালেদা জিয়া) বলবেন, আমেরিকায় কংগ্রেস অবৈধ?”
“সারাবিশ্ব স্বীকৃত দেয়। আর উনি অবৈধ দেখে। উনি কথায় কথায় অবৈধ অবৈধ বলেন। আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করি, উনি এমনই জ্ঞানী হয়ে গেছেন, উনি নাকি সবকিছু অবৈধ দেখেন।”
খালেদাকে ‘আয়নায় নিজের চেহারা’ দেখার পরামর্শ দিয়ে হাসিনা বলেন, “উনি যে অবৈধ দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলে তো দেখবেন, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে..”
তার বাক্য শেষ করার আগেই সমাবেশস্থলে উপস্থিত আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা হাততালি দিতে থাকেন।
শেখ হাসিনা সবাইকে থামিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, “আমি অন্য কিছু বলছি না। আমি আয়নায় চেহারা দেখতে বলেছি অন্য কারণে, আমি উনার মেকআপের কথা বলছি না। আমি উনার মাথার উইগের কথা বলছি না।
“আমি যেটা বাস্তব সেটা বলছি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেছিল অবৈধভাবে। অবৈধভাবে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে সংবিধান লংঘন করে, আর্মি রুলস্ লংঘন করে- জিয়াউর রহমান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিল। অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসে সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে বিএনপির জন্ম।”
দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে দাবি করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “উনি নির্বাচন না করে যে ভুল করেছেন, সেই ভুলের খেসারত জাতি কেন দেবে?”
আওয়ামী লীগ ৩০টি আসনও পাবে না- অষ্টম সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তার যেটা অভিশাপ, আমাদের জন্য সেটা আশীর্বাদ হয়ে ফিরে আসে।
“২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি কিন্তু ২৯টা সিট পেয়েছিল। সেজন্য, পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচনে নির্বাচন করতেই ভয় পেয়েছিলেন।”
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে তারা মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করেছে।
“নিজে নির্বাচন করবেন না। মানুষকে নির্বাচন করতে দেবেন না, মানুষ হত্যা করবেন- বাংলাদেশের জনগণ তো তা মেনে নেয়নি।”
সৈয়দ নজরুলের ছেলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, মনসুর আলীর ছেলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিমও এই জনসভায় বক্তব্য রাখেন।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন তোফায়েল আহমদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মাহাবুব-উল-আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, কামরুল ইসলাম।
যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ, কৃষক লীগের সভাপতি শামসুল হক রেজা, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আশরাফুন্নেসা মোশাররফ, শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ও ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
জেলাহত্যা দিবসের সকালে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতা এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে তারা বনানী কবরস্থানে জাতীয় তিন নেতার কবরে ফুল দেন। কামরুজ্জামানের কবর রাজশাহীতে, সেখানে আওয়ামী লীগ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।