প্রবাসে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া এক বক্তব্য নিয়ে তুমুল আলোচনা এখন মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে।
Published : 30 Sep 2014, 11:08 PM
হজ নিয়ে বক্তব্য: তোপের মুখে লতিফ সিদ্দিকী
লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ চায় বিএনপি
প্রধানমন্ত্রী ফিরলে লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত: কাদের
মঙ্গলবার দিনভর আলোচনার মধ্যে এক পর্যায়ে এই মন্ত্রীকে বরখাস্তের গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কোনো সূত্রে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে তাদের জোট শরিক দলের নেতা এইচ এম এরশাদের কাছ থেকেও।
লতিফ সিদ্দিকীকে বরখাস্ত করার দাবি উঠেছে বিএনপির পক্ষ থেকে। ইসলামী দলগুলো থেকেও একই দাবি তোলা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম তার ফাঁসির দাবি করেছে।
এর মধ্যে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মন্ত্রিসভায় তার এই সহকর্মীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর নেবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সফর করে এখন যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ২ অক্টোবর তার দেশে ফেরার কথা।
মঙ্গলবার বিকালে হঠাৎ খবর ছড়িয়ে পরে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম তা প্রচারও করে।
কিন্তু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করা হলেও নিশ্চিত কোনো তথ্য মেলেনি। কয়েকজন ‘শুনেছেন’ বললেও আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্তের কথা নিশ্চিত করতে পারেননি।
এদিকে যে সব সংবাদ মাধ্যমে অব্যাহতির সংবাদ প্রচারিত কিংবা প্রকাশিত হয়েছিল, তার কয়েকটিকে তা পরে তুলে নিতে দেখা যায়।
অন্যদিকে মেক্সিকো থেকে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, চাপের মুখে পদত্যাগ করবেন না তিনি।
একজন ‘স্বাধীন ও আধুনিক মানুষ’ হিসেবে হজ সম্পর্কে ওই মন্তব্য করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি কিছুই করব না। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দেবেন আমি সেটা প্রতিপালন করব।”
প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত নিউ ইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বক্তব্য থেকে।
সেদিন টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেন, “আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী।”
তার পুরো বক্তব্যের ভিডিও ক্লিপ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
ওই ভিডিওতে তাকে বলতে দেখা যায়, “এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার (জনশক্তি) নষ্ট হয়। এই হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গেছেন। এদের কোনো কাজ নাই। কোনো প্রডাকশন নাই, শুধু ডিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা বিদেশে দিয়ে আসছে।”
অনুষ্ঠান তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন। ‘জয় ভাই’ কে?
“জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন।”
তার এই বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে আলোচনার ঝড় তোলে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা-বিবৃতিও আসতে থাকে।
মন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আমরা অবিলম্বে তাকে বরখাস্ত করে গ্রেপ্তার ও শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।”
বিএনপির মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেন, “তার লাগামহীন কদাচার বক্তব্যকে ক্ষমতার শীর্ষ থেকে সবসময় উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে বলেই এখন তিনি এখন সকল সীমানা অতিক্রম করে পবিত্র হজ ও হাজীদের কটাক্ষ এবং মহানবী (সা:) সম্পর্কে বিদ্রুপাত্মক ভাষায় তাচ্ছিল্য করা ও তাবলিগ জামায়াতকে নিয়ে কটূক্তি করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন।”
বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম লতিফ সিদ্দিকীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্তের দাবি তুলে তা না হলে দেশ অচল করার হুমকি দিয়েছে।
হেফাজতবিরোধী সংগঠন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতও সরকারের এই মন্ত্রীকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে অব্যাহতি দেওয়ার পাশাপাশি তার গ্রেপ্তারও দাবি করেছেন।
এই সব বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে আওয়ামী লীগের কোনো নেতার প্রকাশ্য অবস্থান দেখা যায়নি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেন, সহকর্মীর এই ধরনের বক্তব্য সমীচীন হয়েছে বলে তিনিও মনে করেন না।
বিভিন্ন মহলের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, “বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আছে, তিনি দেশে ফিরলে এ ব্যাপারে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
টাঙ্গাইলে প্রভাবশালী সিদ্দিকীদের জ্যেষ্ঠ ভাই ৭৭ বছর বয়সী লতিফ সিদ্দিকী রাজনীতিতে স্পষ্টভাষী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তীর্যক বক্তব্য দিয়ে এর আগেও আলোচনায় এসেছেন তিনি।
নিজের ভাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর ‘হঠাৎ জামায়াত ঘনিষ্ঠতাকে’ যেমন তিনি ‘বীর উত্তমের রাজাকার হওয়ার শখ’ বলে সমালোচনা করেছেন, তেমনি বাড়িতে ডেকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলীকে পেটানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতি) আসন থেকে পাঁচবার সংসদে যাওয়া লতিফ সিদ্দিকী গত মহাজোট সরকারের পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। শেখ হাসিনা টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর চলতি বছরের শুরুতে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান তিনি।
তবে এই লতিফ সিদ্দিকীই ১৯৮০ এর দশকে প্রবাসে থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতি হওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন, আবার ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর বঙ্গবন্ধুকন্যার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন।
ষাটের দশকে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দিনগুলোতে একাধিকবার কারাগারে যেতে হয় বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য লতিফ সিদ্দিকীকে।
ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে ১৯৬৪-৬৫ সালে করটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ৬৬ ছয় দফা ও ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানে সক্রিয় এই নেতা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসাবে ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে প্রায় ছয় বছর কারাগারে কাটাতে হয়। এরশাদের আমলে স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী নারী সাংসদ হওয়ার পর মুক্তি পান তিনি।
গত সরকারের শুরুর দিকে এক অধিবেশনে সংসদের প্রথম সারিতে মন্ত্রী ও সরকারি দলের সাংসদের অনুপস্থিতি দেখে তখনকার স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ক্ষোভ প্রকাশ করলে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই তার জবাব দেন লতিফ।
সংসদে তিনি বলেন, “স্পিকার হচ্ছেন সংসদের সেবক। তিনি প্রভু নন। কোনো সাংসদের পয়েন্ট অফ অর্ডারেই শুধু রুলিং দিতে পারেন স্পিকার।”
২০১১ সালে পাট নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘যথাযথ মর্যাদা’ না দেওয়ার অভিযোগ তুলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতেই আয়োজকদের তুলোধুনা করেন তখনকার পাটমন্ত্রী লতিফ।
বাংলাদেশে সব পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন চালুর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেই গত বছর রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাকে একটি চিঠি লেখেন তখনকার বস্ত্রমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, যে চিঠির শিরোনাম ছিল ‘ট্রেড ইউনিয়ন প্রশ্নে আপনি বলার কে?’