‘কারো না কারো প্ররোচনায় তথ্য বিকৃতিতে এ কে খন্দকার’

সদ্য প্রকাশিত বই ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ তে মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি এ কে খন্দকার তথ্য বিকৃত করেছেন অভিযোগ করে মুক্তিযুদ্ধে তার সহযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম সন্দেহ করছেন, এতে কারো না কারো প্ররোচনা রয়েছে। 

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Sept 2014, 04:44 PM
Updated : 5 Sept 2014, 05:58 PM

বইটি নিয়ে বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের তীব্র সমালোচনার মধ্যে তিনিও তার এই সন্দেহের কথা জানান।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা অন্যতম গ্রন্থ  ‘অ্যা টেল অফ মিলিয়নস’র লেখক মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল বীর উত্তম খেতাবধারী। বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর প্রথম প্রধান এ কে খন্দকারও বীর উত্তম খেতাবধারী।

রফিকুলের পাশাপাশি আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল করিম সেলিমসহ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কয়েকজন দলের সাবেক সহকর্মী এ কে খন্দকারের তীব্র সমালোচনা করেন। 

এইচ এম এরশাদের সরকারের মন্ত্রী এ কে খন্দকারের সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরাও।

প্রথমা থেকে প্রকাশিত এ কে খন্দকারের বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয় বুধবার। বইয়ে তিনি লিখেছেন, ৭ মার্চের ভাষণ ‘জয় পাকিস্তান’ বলে শেষ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল না বলেও লিখেছেন সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা।

এ কে খন্দকার

এই বই নিয়ে বৃহস্পতিবার সংসদে আলোচনার সূত্রপাত করেন গত সরকারের তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, শেখ হাসিনার যে সরকারে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন এ কে খন্দকার। 

আবুল কালাম আজাদ বলেন, “এখন নতুন নতুন করে বিকৃত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। আমি সেখানে (রেসকোর্স) ছিলাম, উনি (বঙ্গবন্ধু) জয় পাকিস্তান বলেননি।”

তার বক্তব্যের পর ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, “আমিও আজ পত্রিকায় পড়ে বিষয়টি জেনেছি। উনি বহুলাংশে সত্য বলেছেন, তবে আংশিক বিকৃতি করেছেন। তবে কী কারণে করেছেন, তা উনিই ভালো জানেন।”

এরপর অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নেন অন্য সংসদ সদস্যরা। তাদের মধ্য থেকে বইটি নিষিদ্ধের দাবিও জানানো হয়।

মেজর রফিক নামে খ্যাত মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম বলেন, “ইচ্ছাকৃত ভুল হচ্ছে। এই বইয়ের বক্তব্য অসত্য ও ভুল। কোনো মহলের প্ররোচনা থাকতে পারে।”

শেখ হাসিনার ১৯৯৬ সালের সরকারে কিছুকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন রফিকুল। আর বঙ্গবন্ধুকন্যার গত সরকারে ছিলেন এ কে খন্দকার।

রফিকুল বলেন, “কেউ না কেউ তাকে প্ররোচনা দিয়েছেন। অন্য কোনো ইচ্ছায় তিনি জাতির পিতাকে ছোট করার জন্য এটা করেছেন।

“এ কে খন্দকারের সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। তিনি নানাভাবে কাজকর্ম করেন। তিনি সব সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। এই সরকারের কাছ থেকেও সুবিধা নিয়ে তারপর তিনি এই বই লেখেন।”

রফিকুল ইসলাম

“এই বই লেখা নিয়ে তার সাথে আমি দুই-তিন বার বসেছি। তখন তিনি কখনো এই কথা বলেননি।”

“আমরা ‍যুদ্ধ করেছি। খন্দকার সাহেব কলকাতায় হেডকোয়ার্টারে ছিলেন। সামরিক নেতৃত্বে নয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে,” বলেন অবসরপ্রাপ্ত এই সামরিক কর্মকর্তা।

শেখ সেলিম বলেন, “এক শ্রেণির লোক পাকিস্তানের এজেন্ট। খন্দকার সাহেব পাকিস্তানের বুদ্ধি-পরামর্শ নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। কারো ইন্ধনে কোনো এজেন্সির কাছ থেকে মোটা টাকা পেয়েছেন, এজন্য এ বই লিখেছেন।”

তার দলের গত সরকারের মন্ত্রীর সম্পর্কে আওয়ামী লীগের এই নেতা আরো বলেন, “তিনি তো বাংলাদেশে থাকেননি। এরশাদের সময় সুবিধা নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সময় শেখ হাসিনাকে ধরে মন্ত্রিত্ব নিয়েছেন। এদের চরিত্র সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।”

‘বিকৃত ইতিহাস’ রচনা করে এ কে খন্দকার ‘আইএসআইয়ের’ পয়সা খেয়েছেন বলেও সন্দেহ পোষণ করেন শেখ হাসিনার এই ফুপাত ভাই।

এ কে খন্দকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “এ বই থাকতে পারে না। এ বই বাতিল করা হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।”

শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, “বঙ্গবন্ধু এ সিম্বল অব ইন্ডিপেন্ডেন্স। তাকে আঘাত করতে পারলে জাতিকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করা যাবে। এ অপশক্তি তা করতে চাইছে।

“তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকে খাটো করছে না। তারা এ জাতিসত্ত্বা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে টানাটানি করছে।”

‘কৃতজ্ঞতাবোধ নাই’

শেখ হাসিনার গত সরকারে স্থান পাওয়া এ কে খন্দকারের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।

“কেন উনি এসব কথা বলছেন, কেন বই লিখেছেন এবং এ সময় বেছে নিয়েছেন, তাও আমি জানি। অন্যদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন। উনাকে মন্ত্রী বানানো হয়েছিল। কৃতজ্ঞতাবোধ নাই,” সংসদে আলোচনায় বলেছেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এ কে খন্দকারের ভূমিকা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল বলেন, “বঙ্গবন্ধুকন্যা যখন শোকে পাথর, তখন তিনি মোশতাককে সমর্থন করতে গিয়েছিলেন।”

তোফায়েল আহমেদ

১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা তুলে ধরে তখনকার এই ছাত্রনেতা বলেন, “উনি বই লিখলেন, আর ’৬৯ নিয়ে তিনি কিছুই জানেন না! পাকিস্তানের অনেক পত্রিকায় আমার নাম পর্যন্ত ছাপা হয়েছে, আর উনি জানেন না!

“উনি লিখেছেন ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ঘূর্ণিঝড়ের পর ভোলায় না যাওয়া। গণহত্যা ভুল ছিল না? ইয়াহিয়া খান ভোলায় গিয়েছিলেন। আমি সেখানে ছিলাম। উনি (এ কে খন্দকার) জানেন না।”

৭ মার্চের ভাষণের সময় মঞ্চে থাকা তোফায়েল বলেন, “যে যাই বলুন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে জয় বাংলা বলেছিলেন। আমরা তো শুনলাম না (জয় পাকিস্তান বলেছিলেন)। একজন নিজের কথা লিখেছেন।”

এ কে খন্দকারের বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, “উনি লিখেছেন,‘পাকিস্তানে থাকার সময় অনেকের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেয়েছি, অনেক বন্ধু ছিল, পরিবারের যত্ন নিতেন’।”

আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি ছিল না বলে এ কে খন্দকারের মূল্যায়নের সমালোচনা করে তোফায়েল বলেন, “এখানে অনেকে আছেন, আমরা ট্রেনিং নিয়েছি। হাওয়ার উপর দেশ স্বাধীন হয়েছে? প্রস্তুতি ছিল না বলে দিলেন!”

আওয়ামী লীগের জোট শরিক জাসদের সংসদ সদস্য মইনউদ্দিন খান বাদল বলেন, “অভ্রভেদী উচ্চতার বঙ্গবন্ধুকে কিছু সারমেয় ছোট করতে পারবে না। শাসনতন্ত্র বিরোধিতা যদি অপরাধ হয় উনি (এ কে খন্দকার) সেই অপরাধ করেছেন।

“যখন সমস্ত সুবিধা নিলেন, তখন তো কোনো ফোরামে এসব কথা বলেননি। এখন বলছেন, হয়ত বইয়ের কাটতি বাড়তে পারে।”

জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ তার নেতার আমলে মন্ত্রিত্ব পাওয়া এ কে খন্দকার সম্পর্কে বলেন, “তিনি যা লিখেছেন, তা মুখে উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়। কুলাঙ্গাররা এগুলো কোথায় পায়?”

সংসদে একদিন সময় নির্ধারণ করে এই বিষয়ে আলোচনার দাবি জানান তিনি।