হরতালের প্রথম দিনে সংঘাত-নাশকতা

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ১৮ দলীয় জোটের ৬০ ঘণ্টার হরতালের প্রথম দিনটি কেটেছে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ-বোমাবাজি এবং ঢাকার বাইরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2013, 12:41 PM
Updated : 27 Oct 2013, 08:33 PM

রাজধানী ঢাকায় বড় কোনো গোলযোগ না ঘটলেও ফরিদপুর, পিরোজপুর, যশোর, পাবনা ও বগুড়ায় হরতাল চলাকালে হামলা ও সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন পাঁচজন। এদের মধ্যে দুজন বিএনপিকর্মী এবং দুজন যুবলীগ ও একজন জামায়াতকর্মী।  

এছাড়া চাঁদপুর, পাবনা, সাতক্ষীরা, বগুড়া, কক্সবাজার, ফেনী, গাইবান্ধা, ঝিনাইদহ, কিশোরগঞ্জ, নাটোরসহ বিভিন্ন স্থানে হরতালকারীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন পুলিশসহ শতাধিক লোক। 

নাটোর সদরের দত্তপাড়া বাজারে এক যুবলীগকর্মীর হাতের রগ কেটে দিয়েছে জামায়াতকর্মীরা।

জয়পুরহাটে দুটি ট্রেন ভাংচুরের পর হরতাল সমর্থকরা বগিতে আগুন দিয়েছে। তাদের ঢিলের আঘাতে আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ যাত্রী।

রাজধানীতে হরতালের মধ্যে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ভবনের একটি কক্ষে আগুন লেগে বিভিন্ন মামলায় পুলিশের তদন্তের নথি পুড়ে গেছে। এ ঘটনার পেছনে হরতালকারীরা জড়িত বলে পুলিশের সন্দেহ।

আজিমপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কোয়ার্টার থেকে ১৭টি হাতবোমা ও আধা কেজি গান পাউডার উদ্ধার করা হয়েছে।

রাজধানীর কাকরাইল এলাকায় ককটেল ছুড়তে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন এক হরতাল সমর্থক। তাকে পুলিশি পাহারায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বোমাবাজি হয়েছে নির্বাচন কমিশন, সংসদ ভবন ও বিএনপি কার্যালয় এলাকাতেও। 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দাবি, সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল হচ্ছে। বিরোধী দলের আন্দোলন ও গণতন্ত্রকে নসাৎ করতে ‘সরকারের এজেন্টরা’ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমাবাজি করছে।

রোববার দলীয় কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহারের সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, হরতাল সংলাপের জন্য কোনো অজুহাত হতে পারে না।”

২৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টার পর অথবা ৩০ তারিখ- যে কোনো দিন সংলাপ হতে পারে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংলাপের জন্য সরকারকে দুই দিন সময় বেঁধে দিয়ে এই হরতালের ঘোষণা দেন।

এরপর শনিবার বিরোধী দলীয় নেতাকে টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে গণভবনে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান এবং হরতাল তুলে নিতে অনুরোধ করেন।

কিন্তু এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, হরতাল প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়, প্রধানমন্ত্রী যেন হরতালের পর সংলাপের আমন্ত্রণ জানান।  

বিএনপির এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুব-উল-আলম হানিফ রোববার সাংবাদিকদের বলেন, সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ফোন পাওয়ার পরও হরতাল প্রত্যাহার না করে বিরোধীদলীয় নেতা জাতির সঙ্গে ‘বেইমানি’ করেছেন।

হরকালে নাশকতা ‘ঠেকাতে’ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঠে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরাও। বিভিন্ন স্থানে তারা মিছিল করে হরতাল প্রতিহত করার ডাক দেন।

 

রাজধানীর চিত্র

হরতালে বিশৃঙ্খলা এড়াতে রোববার ভোর থেকেই রাজধানীর প্রতিটি সড়কে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও র্যাব সদস্য অবস্থান নেন। এর মধ্যেও সকালের ভাগে যাত্রবাড়ী, মিরপুর, তেজগাঁও, আজিমপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিল নিয়ে নাশকতা ঘটায় হরতালকারীরা।

দারুস সালাম থানার এস আই শহীদুর রহমান জানান, ভোর সাড়ে ৪টার দিকে গাবতলী টার্মিনালের সামনে বিআরটিসির দুটি দোতলা বাস পুড়িয়ে দেয়া হয়।

কাছাকাছি সময়ে মিরপুর বেড়িবাঁধ এলকায় পোড়ানো হয় পাবনা পরিবহনের একটি বাস।

এ সময় সনি সিনেমা হলের দিকে কয়েকটি হাতবোমা ফাটানো হয় বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

 
ফায়ার ব্রিগেড নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা নীলুফার ইয়াসমিন জানান, ভোর সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৬টার মধ্যে আশুলিয়া, টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকা, যাত্রাবাড়ীর দনিয়া, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার সামনে একটি করে বাসে, লালবাগ বেড়িবাধ এলাকায় পাঁচটি বাসে আগুন দেয়া হয়। এছাড়া টঙ্গী ফায়ার স্টেশনের কাছে পোড়ানো হয় একটি অকোরিকশা।

খবর পেয়ে অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়।

মিরপুর থানার ওসি সালাউদ্দিন খান জানান, সাড়ে ৬টার দিকে স্টেডিয়ামের সামনে একদল পিকেটার ককটেল ফাটিয়ে গাড়ি ভাংচুর ও স্টেডিয়ামের দিকে ঢিল ছোড়া শুরু করলে ১২ জনকে আটক করে পুলিশ।

এদের মধ্যে যুবদল ও শিবির কর্মীরা রয়েছে বলে মিরপুরের ওসি জানান।

এছাড়া সকাল ৬টার দিকে জামায়াত-শিবির কর্মীরা প্রশিকা মোড়ে ঝটিকা মিছিল বের করলে সেখান থেকে সাত জনকে আটক করা হয় বলে মিরপুর মডেল থানার এস আই রেজাউল করিম জানান।

যাত্রবাড়ী থানার ডিউটি অফিসার রুহুল আমিন জানান, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বিবিরবাড়ি এলাকায় ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিসে সামনে দুর্বৃত্তরা পেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করে। সেখান থেকে ওই কার্যালয়েও আগুন লেগে যায়।

 

তবে স্থানীয়রাই আগুন নিভিয়ে ফেলেন বলে রুহুল আমিন জানান। 

লালবাগের ওসি নুরুল মোত্তাকিন জানান, আজিমপুর সাদরা মসজিদের সামনে হরতাল সমর্থকরা বেশ কয়েকটি ককটেল ফাটিয়ে মিছিল করার চেষ্টা করলে পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

সকাল সাড়ে ১১টায় মগবাজার জামে মসজিদের দেয়ালে তিনটি ককটেল ফাটায় জামায়াত-শিবির কর্মীরা।

তার কিছুক্ষণ আগেই রমনা থানা আওয়ামী লীগ মগবাজার এলাকায় একটি হরতালবিরোধী মিছিল করে মগবাজার চৌরাস্তায় অবস্থান নেয়।

বেইলি রোড ইউনিটের আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, “জামায়াত-শিবিরের নেতা কর্মীরা মসজিদে এ ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।”

এরপর সকাল সোয়া ১১টার দিকে মগবাজারের মুসলিম সুইটসের সামনে বিকট শব্দে দুটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। এ সময় সেখানে আতঙ্কে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়।

এ সময় রমনা থানা আওয়ামী লীগের নেতারা একজনকে মারধর করে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন।

ফাইল ছবি

বেলা ১২টার দিকে সংসদ ভবনসংলগ্ন ন্যাম ভবনের পশ্চিমে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে পরপর পাঁচটি হাতবোমা ফাটানো হয় বলে

শেরে বাংলানগর থানার ওসি আবদুল মোমিন জানান।

বেলা দেড়টার দিকে নির্বাচন কমিশনের সামনে কয়েকজন মোটর সাইকেল আরোহী হাতবোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

বেলা ২টার ঠিক আগে দুটি হাতবোমা বিস্ফোরিত হয় বিএনপি কার্যালয়ের বিপরীতে শেলটেক অ্যাপার্টমেন্টের গলিতে।

হরতালের কারণে সকালে গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। তবে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক বলে জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।

সকালের প্রথম ভাগে রাজধানীর সড়কগুলোতে গণপরিবহনের সংখ্যাও ছিল তুলনামূলকভাবে কম। তবে রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে।