রায়ে আমরা সন্তুষ্ট: প্রধানমন্ত্রী

যুদ্ধাপরাধের মামলায় গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় বিভিন্ন মহলের ক্ষোভ ও সমালোচনার মধ্যেই রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2013, 01:05 AM
Updated : 16 July 2013, 12:22 PM

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি বলেন, “একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল সাজা দিয়েছে এতেই আমরা সন্তুষ্ট। সাজা কী হতে পারে, এটা আদালতের বিষয়। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। যে সাজা দিয়েছে, যে শাস্তি দিয়েছে- তাতে আমরা সন্তুষ্ট।”

যুদ্ধাপরাধের পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধকালীন আমির গোলাম আযমকে বয়স ও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনায় মোট ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

সোমবার ওই রায় ঘোষণার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। বিকালে তারা সারা দেশে হরতালের ডাক দেন। রায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আপিলের দাবি জানানো হয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল, সেক্টর্স কমান্ডার্স ফোরাম ও বিভিন্ন বাম দলের পক্ষ থেকে। 

প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, “আজ যুদ্ধাপরাধী হিসাবে যারা সাজা পেয়েছে- এটা দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা, দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের ফসল বাস্তবায়ন হয়েছে। আমাদের দল ক্ষমতায় থাকতে এই রায় কার্যকর শুরু করব। কার্যকর হবে ইনশাল্লাহ।”

এর আগে দিনের কার্যসূচির শুরুতে ফ্লোর নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ না হওয়ায় দেশের মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠছে।

এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুরোধ জানিয়ে মেনন বলেন, “সব ভাল যার শেষ ভাল তার। কিন্তু আমরা হোঁচট খেয়ে গেলাম। দেশের মানুষের মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হচ্ছে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অনেকে আওয়ামী লীগকে দোষী করতে চাচ্ছেন। কিন্তু জিয়া এই যুদ্ধাপরাধীদের যখন ফিরিয়ে এনেছিল- তখন তা প্রত্যখ্যান করলে আজ ৪২ বছর অপেক্ষা করতে হতো না।

“ওই সময় যারা বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, জিয়ার সঙ্গে সখ্যতা ও দহরম মহরম করেছিল- সেটা আর বলতে চাই না। এখন সকলেই আমাদের সমর্থন দিচ্ছে। রায় দেয়া শুরু হয়েছে। আমাদের এই সরকারের সময়ে রায় কার্যকর হবে, এটা আমি বিশ্বাস করি।”

গোলাম আযমের বিচারের রায় বাড়িয়েছে। সে বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক আদালত রায় দিয়েছে- জামাতকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

গোলাম আযমের রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকেও যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী করার বিষয়টি সংসদর তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। 

তিনি বলেন, “আমরা অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিচার শুরু করেছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। রায় পাচ্ছি। বিচার হবে। এটাই জাতির বড় পাওয়া।”

গোলাম আযমের রায়ের প্রতিবাদে জামাতের ডাকা হরতালের মধ্যে সংসদ অধিবেশনে যোগ না দেয়ায় বিরোধী দলের সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।

“রায় দেয়ার কথা শুনেই হরতাল ডেকেছে জামাত। তার সমর্থনে বিএনপি সংসদে আসেনি। রায় শুনে আজও তারা আসেনি। গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধের প্রতি বিএনপি নেত্রীর সমর্থন একেবারেই পরিষ্কার। তিনি তা স্পষ্ট করেছেন। দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, এই যুদ্ধাপরাধীদের যারা সমর্থন দেয়- তাদের প্রতি ভাববেন।”

যুদ্ধাপরাধীদের জন্য পার্লামেন্টে অনুপস্থিত থাকায় গোটা জাতি বিরোধী দলকে ধিক্কার জানাবে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

বিরোধীদলীয় নেতাকে উদ্দেশ্য করে সংসদ নেতা বলেন, “এই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে কি না করেছেন? সংখ্যালঘুদের বাড়িতে আক্রমণ করেছেন, বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা করেছেন।”

গত মে মাসে হেফাজতি তাণ্ডবের মধ্যে কোরআনে আগুন দেয়ার ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এই দেখেন কোরান শরীফগুলো কীভাবে পুড়িয়েছে। দেখলে চোখে পানি চলে আসে।”

হেফাজতি তাণ্ডবের ছবি হাতে নিয়ে তাদের ‘সঙ্গ’ ছাড়ার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।

‘শফীর সঙ্গ ছাড়ুন’

নারীদের নিয়ে ‘অবমাননাকর’ বক্তব্যের জন্য হেফাজতে ইসলাম নেতা মাওলানা আহমদ শফীরও সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।

“তাকে আমরা ইসলামী চিন্তাবিদ বলে জানতাম। কিন্তু তার কথা অত্যন্ত লজ্জাজনক।”

সম্প্রতি হাটহাজারীতে এক ওয়াজর আহমদ শফী নারীদের চতুর্থ শ্রেণির বেশি পড়াতে নিষেধ করেন, সমালোচনা করেন সহশিক্ষার। নারীদের চাকরি না করে বাড়িতে রাখার পরামর্শ দেন তিনি। নারীদের নিয়ে আরো যেসব কথা তিনি বলেছেন, তাও কুরূচিপূর্ণ বলে সমালোচনা উঠেছে।

তার ওই ওয়াজের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে এর তীব্র সমালোচনা হয়।

শফীর বক্তব্যের জবাবে বলেন, “মেয়েদের কী তাহলে ঘরে বসে থাকতে হবে? মেয়েরা গার্মেন্টসে কাজ করছেন- তারা তা করতে পারবেন না?”

“বিএনপি নেত্রী কীভাবে ওনাকে সমর্থন করেন? উনি মাওলানা শফীর তেঁতুল হতে চান। তাহলে আমার কিছু বলার নাই।”

শফীর ‘সঙ্গ’ ত্যাগ করে খালেদা জিয়াকে নারী উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।

বিএনপির সময়ে সাংসদ শাহ এ এম এস কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ড, ২০০৪ সালের ২১ অগাস্টের গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।… পুরস্কার হিসাবে ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার অভিযুক্তের ভাইকে ছাত্রদলের সভাপতি করা হয়।”

বর্তমান সরকারের সময়ে ছাত্রলীগের ছয় শ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, “এর আগে, কোনো দল এটা করেছে কিনা জানি না। অন্যায়কে আমরা প্রশ্রয় দেইনি। দেব না। কিছু আছে পারমানেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি। তারা যখন যে দল ক্ষমতায় সে দলে যোগ দেয়। অনেকে না বুঝে দল ভারি করার জন্য নেয়।”

বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা ছাত্রলীগে যোগ দেয়ার আবেদন করেছিল উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, “অনেকে আগেই ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছিল। বিশ্বজিৎ হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের পরিবারের অনেকে জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।”

অতীতে আর কোনো সরকারের সময় নির্বাচন কমিশন এখনকার মতো স্বাধীনতা পায়নি দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা গণতান্ত্রিক ধারাকে সম্মান করি।গণতান্ত্রিক ধারা যেন অব্যাহত থাকে সেটাই আমরা চাই।”

বর্তমান সরকারের সময়ে স্থানীয় ও উপ-নির্বাচনসহ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা সরকারে আছি। অনেক নির্বাচনে পরাজিত হয়েছি। কিন্তু আমরা মেনে নিয়েছি। একটি নির্বাচন নিয়ে কেউ অভিযোগ করতে পারে নাই।”

নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করতে যতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা নেয়া হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

বাংলাদেশকে আর্থ সামাজিকভাবে এগিয়ে নিতে নতুন অর্থবছরের বাজেটকে ‘যথার্থ’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “এই বাজেট বাস্তবায়নে আমরা বেশি সময় পাব না। তবে জনগণ যদি ভোট দিয়ে জয়ী করে আবার তাদের সেবার সুযোগ দেয়, তাহলে এই বাজেট বাস্তবায়ন করব।”

দীর্ঘদিন পর বিরোধী দল এবার সংসদে ফেরায় তাদের ধন্যবাদ জানান সংসদ নেতা।

একইসঙ্গে তিনি বলেন, “পার্লামেন্টে এসে আলোচনা করেছে সেজন্য ধন্যবাদ। অনেকের বক্তব্য ছিলো নোংরা, কুরুচিকর। কে কী কথা বলবে সেটা তার রুচির বিষয়। তারপরও যে আলোচনায় এসেছে- সেটা ভাল।”

এই অধিবেশনেই অভিষিক্ত স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ‘দক্ষতার সাথে’ অধিবেশন পরিচালনা করেছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।