নির্বাচন নিয়ে সংসদে বিতর্ক

বাজেটের মঞ্জুরি দাবির উপর আলোচনার সময় নির্বাচন ব্যবস্থা বিতর্ক হয়ে গেল সংসদে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 June 2022, 01:02 PM
Updated : 30 June 2022, 01:02 PM

বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। বিএনপির সদস্যরা তুলেছেন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি।

তার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আদালতের রায়ের বাইরে গিয়ে নির্দলীয় সরকার আনার কোনো সুযোগ নেই।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের এখনও দেড় বছর বাকি থাকলেও নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর সেই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনা চলছে।

বৃহস্পতিবার সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে প্রস্তাবিত দায়যুক্ত ব্যয় ব্যতীত অন্যান্য ব্যয় সম্পর্কিত মঞ্জুরি দাবির উপর আলোচনায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের বরাদ্দের দাবি নিষ্পত্তির সময় নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গ আসে।

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, “সুষ্ঠু ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা (ইসি) এখন দন্তহীন বাঘ।”

“নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালী হবে তত্ত্বাবধায় সরকারের দাবি তত যৌক্তিকতা হারাবে,” মন্তব্য করে ইসির অধীনে ‘নির্বাচনী পুলিশ’ গঠনের প্রস্তাব করেন এই আইনপ্রণেতা।

জাতীয় পার্টির সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সঠিকভাবে কাজ করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।

হারুনুর রশীদ

গত ১০ বছরে নির্বাচন কমিশনের উপর মানুষের ‘অনাস্থা তৈরি হয়েছে’ দাবি করে বিএনপির হারুনুর রশীদ কটাক্ষ করে নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ অর্থ প্রশাসন ও পুলিশকে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “এখন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করে না। নির্বাচন করে প্রশাসন।”

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, “যখন দেশে নির্বাচন থাকে তখন নির্বাচন কমিশনের প্রশ্ন আসে। যদি নির্বাচন না থাকে, দিনের ভোট রাতে হয়, তখন নির্বাচন কমিশন দিয়ে কী হবে?

“এখন নির্বাচন মল্লযুদ্ধ। সিইসি বলেছেন, ভোটের মাঠে বিএনপিকে জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকতে হবে। ভোট কি যুদ্ধ? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন বুথে ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। এই ডাকাত শুধু দলীয় ডাকাত নয়। পুলিশ প্রশাসনও এই ডাকাতি করে। এই ডাকাতির পর যেভাবে পুরস্কৃত করা হয় ভবিষ্যতে ডাকাত আরও বাড়বে।”

সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কোনভাবেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হারুন।

ইভিএমের বিরোধিতা করে বলেন, “সাবেক সিইসি নূরুল হুদা এখন বলছেন, ইভিএমে কিছু ত্রুটি আছে। তাহলে তিনি কেন ইভিএমে নির্বাচন করলেন? একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, গোপন কক্ষে থাকা ডাকাত বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ ইভিএম চায় না।

“আওয়ামী লীগ এক সময় বলেছিল, আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এখন বিএনপিকে ছাড়া কি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে? পারবেন না। বিএনপিকে কীভাবে নির্বাচনে আনবেন সেটা বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে অবশ্যই নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে। অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে হবে। সে জন্য নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকতে হবে।”

রুমিন বলেন, “সাবেক নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীনকে পুরস্কার হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। অবসরে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগে তিনি ইউরোপ সফরে যান। সে সফরের অভিজ্ঞতা তিনি অবসর জীবনে কাজে লাগাবেন। এভাবে পুরস্কৃত করতে থাকলে বিনা ভোটে সংসদ গঠন চলতেই থাকবে।”

রুমিন ফারহানা

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “সেখানে একজন সংসদ সদস্যকে নির্বাচন কমিশন সামাল দিতে পারেনি। তার হুমকি-ধমকি সহ্য করতে পারেনি। বারবার অনুরোধ করে তাকে এলাকা থেকে সরাতে পারেনি। যে কমিশন একজন সংসদ সদস্যকে সামলাতে পারে না তারা জাতীয় নির্বাচনে তিনশ সংসদ সদস্যকে কীভাবে সামলাবেন?”

বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, “আওয়ামী লীগের একটি পুরনো খেলা আছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকলে তার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো মোটামুটি সুষ্ঠু করা হয়। ২০১৪ সালেও এই খেলা দেখা গেছে।”

জাতীয় পার্টির রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, “ইভিএমের কোনো দোষ নেই। যারা ইভিএমে প্রভাব খাটায় ব্যালটেও তারা প্রভাব খাটাতে পারে। এ বিষয়টি বন্ধ করতে হবে।”

একই দলের জ্যেষ্ঠ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেন।

তিনি বলেন, “নির্বাচন করে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা যদি সুষ্ঠু পরিবেশ করে দিতে না পারে তাহলে নির্বাচন কমিশন ঢাকায় বসে কিছুই করতে পারবে না। সবাই নির্বাচনে জিততে চায়। এখানে কোনো এথিকস মানে না। যেদিকে শক্তি বেশি থাকে, স্থানীয় প্রশাসনও সেদিকে চলে যায়।

“আসলে নির্বাচন কমিশনসহ কোনো কমিশনই স্বাধীন নয়। সব সরকারের আমলেই এটি হয়েছে, এটি চলতেই থাকবে।”

গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, “নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার মূল কারণ তারা (ইসি) সরকারের আজ্ঞাবহ। চারটি দল শুধু ইভিএমের পক্ষে আর বেশিরভাগই বিপক্ষে। আজ্ঞাবহ না হয়ে নির্বাচন কমিশনকে জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইভিএম বাদ দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।”

বিরোধী সদস্যদের আলোচনার জবাব দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “বিএনপির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এখানকার আসনে বসে বলছেন নির্বাচন হয় না। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, উনি সংসদে গেলেন কীভাবে? এর জবাব উনি দেবেন।”

আনিসুল হক

বিএনপি আমলে ভোটের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভোট কীভাবে হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। ওই সময় কারও ভোট কেন্দ্রে যাওয়া লাগত না, ভোট হয়ে যেত। আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন তাদের (বিএনপি) ছিল। মাগুরার ভোটের কথাও সবাই জানে। ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি কী করেছে, এগুলো কি উনারা ভুল গেছেন?”

বিএনপির সদস্যদের নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ ছাঁটাই করে এক টাকা দেওয়ার প্রস্তাবের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, “উনারা বলেছেন এক টাকা দিতে। উনারা পারবেন এক টাকা দিয়ে কোনো নির্বাচন করে দিতে? পারবেন না। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের টাকা লাগবে। নির্বাচন কমিশন তার অর্থ ব্যয়ে পুরোপুরি স্বাধীন।”

অবসরের দুই দিন আগে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীনের বিদেশ সফর বিষয়ে রুমিনের অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “বিদেশের আমন্ত্রণে মন্ত্রী মহোদয় এবং সচিব টিম নিয়ে ডেল্টা প্লান বিষয়ে গিয়েছিলেন। তারা সেখান থেকে শিখে এসেছেন। এটা হয়েছে বিদেশি সরকারের ব্যবস্থাপনায়। তখন তিনি সচিব ছিলো। এখানে কি কোনো অন্যায় আছে? জানি না, উনি কোথা থেকে অন্যায় দেখলেন।”

নির্বাচন কমিশন আইন তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, “এখন বিএনপির দাবি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতে হবে, তাহলে উনারা ভোটে আসবে। এই সংসদে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্ববধায়ক সরকারকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। উচ্চ আদালতের এই রায়ের এক সুতাও বাইরে সরকার যাবে না।

“বিএনপি বার বার বলছেন, তাদেরকে নির্বাচনে আনতে হবে। তারা কি পাকিস্তানে থাকে যে সেখান থেকে ডেকে আনতে হবে? তারা তো বাংলাদেশে থাকে। উনারা নির্বাচন করতে চাইলেই নির্বাচন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের যে জন্য প্লেইং ফিল্ড দরকার সেটা করা হবে। তার এ পদক্ষেপ হচ্ছে নির্বাচন কমিশন গঠন আইন। সেটা করা হয়েছে।”

পরে আরেকটি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ছাঁটাই প্রস্তাব তুলতে গিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বিএনপির হারুন বলেন, “বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে বলিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছেন।

“বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচন জাতীয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়াতে কোনো কৃতিত্ব নেই। মাঠে মূল প্লেয়ার দুটা, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলকেই মাঠে রাখতে হবে।”