ইভিএম: কুমিল্লা নিয়ে বাহবা, হাতিয়া নিয়ে ক্ষোভ

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় মতবিনিময় সভায় কুমিল্লার ভোট নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রশংসা কুড়ালেও হাতিয়ার ইউপি ভোট নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন কমিশন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2022, 07:37 PM
Updated : 28 June 2022, 07:37 PM

মঙ্গলবার বিকালে নির্বাচন ভবনে ইভিএমের কারিগরি দিক যাচাই এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে যন্ত্রটির ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির শেষ ধাপের সভায় ১০টি দল অংশ নেয়। আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল বৈঠকে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে, বাকিরা বিরোধিতা করেছে।

বর্তমান ইসির অধীনে গত ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন, একটি উপজেলা এবং ১৩৪ ইউপিতে ইভিএমে ভোট হয়। ইসির প্রথম প্রয়াস ‘বেশ সফল’ হয়েছে বলে কমিশনকে বাহবা দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৈঠকে বলেন, “আওয়ামী লীগ মনে করে, সিইসির নেতৃত্বে বর্তমান ইসি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি সুন্দর নির্বাচন আয়োজন করেছে। এ নির্বাচন দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। আমার মনে হয়, আপনাদের প্রথম প্রয়াস যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।”

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দুই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ৩৩ জন প্রার্থী বিষের বোতল আর কাফনের কাপড় নিয়ে গত ৩১ মে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিল, স্থানীয় সংসদ সদস্যের স্বামীর ‘জুলুমের’ কারণে ভোটের মাঠে তারা প্রচার চালাতে পারছেন না। তবে নোয়াখালী-৬ আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।

ঢাকায় এসে প্রার্থীরা পরিস্থিতি তুলে ধরলেও পরে নির্বাচনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে মনে করেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।

ইসির মতবিনিময় সভার এই শেষ বক্তা ইভিএমকে ‘ভালো’ বললেও ভোটে অনিয়ম ও ‘ডাকাতদের’ বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রশ্ন তোলেন।

হাতিয়ার ভোটের চিত্র তুলে ধরে ওমর ফারুক বলেন, “ইভিএমের এ ভোটের সচিত্র প্রতিবেদন হয়েছে- চটের বেড়া দেওয়া গোপন কক্ষে গোপন লোক অবস্থান করেছে। ভোটের দিন সাড়ে ১২টায় তারা নির্বাচন বর্জন করেছে, যারা কাফনের কাপড় পরে ইসিতে এসেছিল।

“আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইভিএমে ভোট করেছেন, সে ইভিএমের সচিত্র প্রতিবেদন এসেছে। কাফনের কাপড় পরে যারা প্রতিবাদ করতে প্রত্যন্ত দ্বীপ হাতিয়া থেকে ঢাকায় এসেছে; পরে তারা বর্জন করেছে। ইভিএমের এ বিষয়গুলো আপনারা অ্যাড্রেস করেছেন কি না, আমার কথা হল-এভিডেন্স দিয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে। হ্যাঁ, আমি ভোট বাতিল করেছি, গেজেট বাতিল করেছি। এ ধরনের নজির আপনাদের কাছে আছে কি না।“

ইভিএমে হ্যাঁ না

মঙ্গলবারের বৈঠকে ইভিএমের পক্ষে মতামত দিয়েছে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল-এমএল, গণতন্ত্রী পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। 

আর ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে- বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও গণফোরাম।

আমন্ত্রিত হয়েও বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টি, বাসদ, এলডিপি ও সিপিবি বৈঠকে যায়নি।

এর আগে গত ১৯ ও ২১ জুন দুই ধাপে ২৬টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ইভিএম যাচাই বিষয়ক সভা করে ইসি। এই দুই ধাপে ১৮টি দল উপস্থিত থাকলেও সাড়া দেয়নি বিএনপিসহ আটটি দল।

মঙ্গলবারের সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “আজকে যে রাজনৈতিক দলগুলো এখানে আসছে, আমার মনে হয় অধিকাংশই ইভিএমের পক্ষে বলেছেন। আজকে অনেকগুলো দল এসেছে। আমরা সবার কথা শুনেছি। ইভিএম নিয়ে বিরুদ্ধেও বলেছেন দুয়েকজন। এটা তো গণতন্ত্র।”

তিনি বলেন, “আমরা গত নির্বাচনের সময় কমিশনে বলেছি- আমাদের দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের পার্টির স্ট্যান্ড হচ্ছে- দিস ইজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার- আমরা ইভিএম পদ্ধতির পক্ষে, রাখঢাক করে কোনো লাভ নেই।“

ইভিএমকে উন্নত প্রযুক্তি হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশের ওয়াকার্স পার্টি সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।  তিনি বলেন, “ইভিএম ব্যবহারে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে ইভিএম ব্যবহারের আগে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট করলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।”

তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল হক চাঁদপুরী বলেন, “সবাই যেহেতু ইভিএম বিষয়ে একমত না, এজন্য কমপক্ষে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে।”

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ১৪ দল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর চায়৷ আওয়ামী লীগের দেওয়া প্রস্তাবের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন তিনি। 

ইভিএম ‘আধুনিক ব্যবস্থা’ বলে মনে করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন। তার ভাষায়, “ইভিএম পরিচিত করানো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই মূহুর্তে তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট করা ঠিক হবে না।“

আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন করার পক্ষে মত দেন তিনি।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ আসনে ইভিএমে ভোট করার পক্ষে মত দিয়ে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বলেন, “মেশিন যদি ঠিকঠাক থাকে, মেশিন ভালো সার্ভিস দিবে।”

বিকল্প ধারার মহাসচিব আব্দুল মান্নান বলেন, “আমরা অবশ্যই ইভিএম চাই। তবে প্রশ্ন হলো এই প্রযুক্তিতে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন কি না? সবগুলো বুথে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা আছে কি না?”

ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়ে গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরাইয়া বেগম বলেন, “ইভিএমের মাধ্যমে খুব সহজেই জালিয়াতি করার অনেক মেকানিজম রয়েছে। ই ভোটিং পদ্ধতিতে প্রোগামিং পরিবর্তন করে জালিয়াতি করার সুযোগ থেকেই যায়।”

ইভিএমের মাধ্যমে ভোটাধিকারকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ করতে চান না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হলেও সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি থেকে সরে আসা উচিত।” 

বাংলাদেশ আওয়ামী ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া মনে করেন, ইভিএমের পুরো পদ্ধতিতেই ‘আস্থার সংকট’ রয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হবে না।  

ইভিএমে সায় না দিয়ে সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সভা প্রধান আবু লায়েন্স মুন্না বলেন, “দেশের ৮০ শতাংশ ভোটার গ্রামে বাস করে।  তাদের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে।“ 

এরপরও আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে কেবল সরকার ও নির্বাচন কমিশনই আগ্রহী বলে মন্তব্য করেন তিনি।