নিজাম উদ্দিন কায়সার নির্বাচনে জিতে কুমিল্লার মেয়র হতে পারবেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দুদিন পরেই জানা যাবে। তবে তিনি যে ভোটের হিসাব কিছুটা হলেও কঠিন করে তুলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই কারও।
এতকাল কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বহু ধারা, উপধারার কথা জানা গেলেও বিএনপির বিরোধ তেমন একটা প্রকাশ্য ছিল না। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কায়সারের প্রার্থী হওয়ার মধ্যে দিয়ে বিএনপির বিভক্তিও সামনে এসেছে।
কুমিল্লার রাজনীতির খবরাখবর যারা রাখেন, তাদের কারও কারও ধারণা, গত দুইবারের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কুর ‘যাত্রাভঙ্গ করতে’ কায়সারের নির্বাচনে আসা।
কায়সার ওই ধারণাকে ‘অবান্তর প্রচার’ বলে উড়িয়ে দিলেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পরিবারের লোকজন চেয়েছিল আমি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হই। এই জন্য কলেজে বিজ্ঞান পড়তে বাধ্য করেছিল। আমি কলেজে গিয়ে জড়িয়ে পড়ি ছাত্র রাজনীতিতে। কুমিল্লা জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ঠিক করেছিলাম রাজনীতিই হবে আমার ক্যারিয়ার। তাই এই নির্বাচন।”
তবে মাত্র কয়েক দিনের প্রচারে কায়সার নিজেকে নিয়ে এসেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। তার সঙ্গে বিএনপি এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও দেখা যাচ্ছে বেশ।
কুমিল্লার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক সাক্কু এবং আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাতের চেয়ে কায়সারকে পিছিয়েই রাখছেন।
৪২ বছর বয়সী কায়সার কিছুদিন আগেও ছিলেন কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এবং একই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক। মনিরুল হক সাক্কু ছিলেন বিএনপির কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
সাক্কু ২০০৫ সালে প্রথমবার কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান হন। ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ছিলেন পৌরসভার মেয়র। এরপর কুমিল্লা পৌরসভা সিটি করপোরেশনে উন্নীত হলে তিনি দুই দুবার মেয়রের চেয়ারে বসেছেন।
নিজাম উদ্দিন কায়সার কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ভোটের লড়াই তার এবারই প্রথম।
বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় সাক্কু ও কায়সার দুজনই দল থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন। দল সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধে’ গত ১৯ মে তাদের ‘চিরতরে বহিষ্কার’ করে।
২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের উপ নির্বাচনের পর আর কোনো নির্বাচনে যায়নি বিএনপি। গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনেও তারা যাবে না।
বিএনপির সাক্কু ২০১২ সালেও দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে নির্বাচন করেছেন। তবে ২০০৫ সালের পৌরসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ২০১৭ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তিনি কুমিল্লা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ‘আনুকূল্য পেয়েছেন’ বলে বিএনপিতেই আলোচনা আছে।
কুমিল্লার ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি বইয়ের লেখক, কলামিস্ট আহসানুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাহারের সঙ্গে সাক্কুর সম্পর্ক কুমিল্লার মানুষের কাছে ওপেন-সিক্রেট। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়েছেন বাহারের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত। ফলে সাক্কুর পেছনে আশীর্বাদের সেই পুরনো হাত আর নেই।”
কুমিল্লার রাজনীতিতে বাহারের প্রভাব সুবিদিত। তিনি কুমিল্লা ৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন, সেনানিবাস এলাকা) আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। তার চাওয়াতেই রিফাত এবার ১৩ জনকে পেছনে ফেলে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বলে দলের নেতাকর্মীদের ভাষ্য।
আহসানুল কবীর মনে করেন, কায়সার হঠাৎ নির্বাচনের মাঠে অবতীর্ণ না হলে এবারও সাক্কুর জন্য বৈতরণী পার হওয়া খুব বেশি কঠিন হত না।
“সাক্কুর জন্য এখনও লড়াইটা খুব কঠিন হয়নি। কুমিল্লার রাজনীতি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা জানেন, আওয়ামী লীগের অন্তত তিনটি ঘরানার ভোট দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে যাবে।
“এই তিন ঘরানার সবচেয়ে বড় ভোট ব্যাংকটি প্রয়াত আফজল খান পরিবারের। সাক্কু ২০১২ সালে আফজল খান এবং ২০১৭ সালে তার মেয়ে বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে মেয়র হয়েছেন। কায়সারের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেলে এই ভোট ব্যাংক তার হতে পারত।”
তবে কায়সারের মধ্যে এখনও সেই সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না আহসানুল কবীর। তার মতে, ভোটের মাঠে নৌকার বিরুদ্ধে সাক্কুর ঘড়ি মার্কা এগিয়ে আছে।
“তাই বাহারের সঙ্গে বিরোধিতার কারণে যারা দলীয় প্রার্থীর পরাজয় দেখতে চান, তারা কায়সারের ঘোড়া প্রতীকে নয়, সাক্কুর ঘড়িতেই হয়ত আস্থা রাখবেন।”
সীমা জানালেন, তিনি ঢাকায় আছেন। ভোট দিতে কুমিল্লায় আসবেন। বললেন, “সুযোগ থাকলে প্রকাশ্যে ভোট দিতাম।... নৌকার কর্মী-সমর্থকরা ব্যালটে নৌকা মার্কা দেখলে অন্য কোথাও ভোট দিতে পারে না।”
নিজাম উদ্দিন কায়সার আশা করছেন, দোদুল্যমান ভোটের বেশির ভাগটা তিনিই পাবেন। তবে বিএনপি সমর্থকদের ভোটই তার ‘জয়ের জন্য যথেষ্ট’ বলে মন্তব্য তার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নৌকা মার্কা বাহার সাহেবের কাছে ‘আপন পোলা’ আর ঘড়ি ‘পালক পোলা’। নৌকা জিতলে উনার শতভাগ জয়। ঘড়ি জিতলে অন্তত সত্তর ভাগ।”
২৫ এপ্রিল তফসিল ঘোষণার দিনে নিজেকে একজন মেয়র প্রার্থী বলে জানান দেন নিজাম উদ্দিন কায়সার। দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও দলের নামেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার পেছনে রয়েছেন তার বোনের স্বামী, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন।
এ পরিবার মনে করে, সাক্কুর ‘রহস্যজনক ভূমিকায়’ ইয়াছিন বিভিন্ন সময়ে সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। সাক্কুর সঙ্গে কোন্দলের কথা অস্বীকারও করেন না তারা।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসনে ইয়াছিন ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের বাহাউদ্দিন বাহারের কাছে হেরে যান। ইয়াছিনের অনুসারীরা মনে করেন, বাহারের জয়ের পেছনে ‘ভূমিকা ছিল’ সাক্কুর।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইয়াছিন বলেন, “সাক্কুর সঙ্গে আমার মতপার্থক্য রয়েছে। এই মতবিরোধ আমার একার নয়, আমাদের দলের। দু’দুবার মেয়র হয়ে তিনি দলের জন্য কিছু করেননি। খোদ এমপি বাহার তার দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন।”
সাক্কুর ভোটে ভাগ বসাতে কায়সারকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছেন- এমন প্রচারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইয়াছিন বলেন, “কায়সার আমার শ্যালক, এটাই আমাকে অভিযুক্ত করার একমাত্র কারণ। ও নির্বাচনে দাঁড়াবার পর আমি কুমিল্লায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, কুমিল্লাতেই আমার লালমাই ফুটওয়্যারের সব কারখানা। সেখানে শত শত কর্মী রয়েছে। আমি নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর বায়ারদের নিয়ে মাত্র একদিনের জন্য কুমিল্লায় গিয়েছিলাম।”
কায়সারের পেছনে ইয়াছিনের কর্মীদের দেখা যায়- সে কথা তুললে এই বিএনপি নেতা বলেন, “কায়সার নিজেও তো বিএনপি করেছে। নির্বাচন করতে নেমে বহিষ্কৃত হয়েছে। কর্মীরা তাকে ছেড়ে যায়নি।”
আর নিজাম উদ্দিন কায়সার বলছেন, “নেতাকর্মীদের শুধু সঙ্গেই পাচ্ছি, তা নয়। আমার জন্য দিনরাত এক করে কাজ করছেন তারা। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের দানবীয় শাসনের সঙ্গে সাক্কুর যে ঐক্য, তারা এর অবসান চান। নেতাকর্মীদের দেড় শতাধিক হয়রানিমূলক মামলা আমার পরিবারের খরচে পরিচালনা করেছি আমি। কখনো কর্মীদের ছেড়ে যাইনি।”
অন্যদিকে মনিরুল হক সাক্কুর ভাষ্য, কারো ‘অপপ্রচারে’ তার ভোটে কোনো টান পড়বে না।
“আমি বিএনপির সাক্কু। দলে থাকি কিংবা দল আমাকে বহিষ্কার করুক। আমার সব নির্বাচনেই কর্মীরা ছিল বিজয়ের চাবিকাঠি। নির্বাচন আর সাংগঠনিক বিষয় এক নয়। ভোট দেবে জনগণ আর রাজনীতি করবে কর্মীরা।”
কায়সারের সমালোচনা করে সাক্কু বলেন, “তিনি হঠাৎ এসে প্রার্থী হয়ে গেছেন। এখন ভোট পেতে বেগম জিয়ার নাম বিক্রি করছেন, আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। আমি দুইবারের মেয়র, কুমিল্লার মানুষ আমাকে চেনে।”