ইসির নির্দেশ উপেক্ষা করে সরকারদলীয় ওই এমপির এলাকায় অবস্থান করার মধ্যে ‘বাহারের বাহাদুরি’ দেখতে পাচ্ছেন মেয়র পদের দুই প্রার্থী মো. মনিরুল হক সাক্কু ও নিজাম উদ্দিন কায়সার, যারা ভোট করার ‘অপরাধে’ বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতের ভাষায়, বাহারকে এলাকা ছাড়তে বলা সাক্কুর মুখে ‘মানায় না’ আর সেটা কুমিল্লার মানুষ ‘মেনেও নেবে না’।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, কোনো সংসদ সদস্য স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রচারে অংশ নিতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকার ভোটার হলে শুধু ভোট দিতেই নির্ধারিত কেন্দ্রে যেতে পারেন।
কিন্তু কুমিল্লা ৬ (আদর্শ সদর, সিটি করপোরেশন, সেনানিবাস এলাকা) আসনের সংসদ সদস্য বাহার আইন ভেঙে দলীয় প্রার্থী রিফাতের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠলে তাকে সতর্ক করে নির্বাচন কমিশন। তাতে কাজ না হওয়ায় বুধবার তাকে এলাকা ছাড়তে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু প্রথম দফা সতর্কবার্তা পেয়েই আদালতে গিয়েছিলেন বাহার। তাকে নির্বাচনের প্রচারে সুযোগ না দেওয়া কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাই কোর্ট।
এরপর পেরিয়ে গেছে তিন দিন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেরও আর তিন দিনই বাকি। ইসির নির্দেশ পাত্তা না দিয়ে বাহার এখনও কুমিল্লাতেই আছেন; দৃশ্যত একটু আড়ালে চলে গেলেও ভোটের আলোচনার কেন্দ্রেই তিনি আছেন।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছেড়ে ভোটে আসা ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী কায়সারের অভিযোগ, “এমপি বাহার নির্বাচনকে নৌকার পক্ষে প্রভাবিত করতে কাজ করছেন। তিনি পেশাজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে ডেকে এনে নৌকার পক্ষে কাজ করতে বাধ্য করছেন।“
তার ভাষায়, “তিনি (বাহার) নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাকে পাত্তা না দিয়ে বাহাদুরি দেখাচ্ছেন।“
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে ভোটে আসা বিগত মেয়র সাক্কু এবার লড়ছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে। শনিবারও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এবং সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সাক্কু বলেন, ভোটের মাঠে সবার জন্য সমান সুযোগ ‘নিশ্চিত করতে পারেনি’ নির্বাচন কমিশন।
“সংসদ সদস্য বাহার নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে এটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি এখানে থাকলে ভোট প্রভাবিত হবে, কারচুপিও হতে পারে।”
তাদের অভিযোগের পাল্টায় নৌকার প্রার্থী রিফাতও সরব হয়েছেন। শনিবার সকালে নগরীর রানীর দিঘির পাড়ে নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
আর যাকে ঘিরে এত আলোচনা, কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য বাহার এ বিষয়ে এখন কথা বলতে চান না সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে।
শনিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তিনি কুমিল্লা নগরীর মুন্সেফ বাড়ি এলাকায় নিজের বাসভবনের সামনে ব্যক্তিগত কার্যালয়েই ছিলেন। ওই সময় দলীয় নেতাকর্মীরাও সেখানে গেছেন, বাহার তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
বিকালে নগরীর রামঘাট এলাকায় মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে যান বাহার। ইসির নির্দেশনার পরও এলাকায় থাকার বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে বারবার কথা বলার চেষ্টা করেও এমপির সাড়া মেলেনি।
তবে শুক্রবার তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইসির নির্দেশনা চ্যালেঞ্জ করে তিনি উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ইসির প্রতি রুল জারি করেছে। আদালতের কাগজ হাতে পেলে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।
কেন বাহারকে নিয়ে এত আলোচনা
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সিটি নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের আগে থেকেই প্রকাশ্যে তিনি ভোটের প্রচারে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
তার সংসদীয় এলাকার মধ্যে সিটি করপোরেশনও রয়েছে। দলীয় কার্যালয়ে তিনি একের পর এক কর্মীসভা ও মতবিনিময় অনুষ্ঠান করে গেছেন।
তার আলোচনার থাকার আরেকটি কারণ আওয়ামী লীগের প্রার্থী রিফাত এবং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আগের দুই বারের মেয়র সাক্কুর সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সম্পর্ক।
কুমিল্লার রাজনীতিতে এই দুই প্রার্থী দুই দলের হলেও তারা বাহারের ‘শিষ্য’ বলেই পরিচিত। এ কারণেই রিফাত ও সাক্কুর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে ভোটের গল্পের বার বার ফিরে আসছে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহারের নাম।
মেয়র পদে গত ১৩ মে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান রিফাত; যিনি কুমিল্লার রাজনীতিতে বাহারের প্রধান অনুসারী বলে পরিচিত।
দলীয় মনোনয়নের দুদিন পর রিফাতকে নিয়ে কুমিল্লায় আসেন বাহার। নগরীর রামঘাট এলাকায় আওয়ামী অফিসে করেন বিশাল ‘শো-ডাউন’। পরদিন ১৬ মে ইসি তাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়। তখন তিনি উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন।
নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলে গত ৬ জুন থেকে বাহারের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দফায় দফায় চিঠি দিয়ে আসছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাক্কু। বিএনপিতে তিনি এতকাল ‘বাহারের শিষ্য’ বলেই পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ থেকে রিফাত মনোনয়ন পাওয়ায় ‘গুরু-শিষ্য’ বাহার-সাক্কুর সম্পর্কে চিড় ধরেছে বলে নেতাকর্মীদের ভাষ্য।
রিফাত আওয়ামী লীগের কুমিল্লা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। শুরু থেকে এই কমিটির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন বাহার। ২০০৮ থেকে টানা তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
সাক্কু সর্বশেষ শনিবার বিকালেও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে বাহারের বিরুদ্ধে ‘নির্বাচনের প্রভাব বিস্তার করার’ অভিযোগ এনেছেন।
সেখানে তিনি দাবি করেছেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করে ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন করে’ মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসার প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের সঙ্গে ও আদর্শ সদর উপজেলার নেতাকর্মীদের একত্রিত করে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলার দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়েও ‘নির্বাচনী কার্যক্রম’ পরিচালনা করছেন স্থানীয় এমপি।
স্বতন্ত্র এ প্রার্থীর একের পর এক অভিযোগে গত বুধবার বাহারকে নির্বাচনী এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয় ইসি।
সেখানে বলা হয়, সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬ এর ২২ বিধি অনুযায়ী ‘সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ নির্বাচনী এলাকায় প্রচার বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না।
“বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সম্প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, কুমিল্লা ৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন অত্যন্ত কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করছেন, যা সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালার লঙ্ঘন। এ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে তদন্ত করালে লিখিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, যা মোটেই কাম্য নয়।”
স্থানীয়রা বলছেন, কুমিল্লার রাজনীতিতে এই প্রথমবারের মত বাহারের সঙ্গে সাক্কুর দূরত্ব প্রকাশ্যে এসেছে।
অথচ সেই বাহার এবার সাক্কুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে ভোটের মাঠে সরব। নগরীর কান্দিরপাড় এলাকার একটি ভবনের নকশা অনুমোদনে ‘৮০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার’ অভিযোগও এর মধ্যে রয়েছে। সাক্কুর দাবি, ওই অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’।
২০১২ সালে সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন কুমিল্লার বর্ষীয়াণ আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খান। তার মৃত্যুর পর ২০১৭ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আস্থা রাখে তার কন্যা আঞ্জুম সুলতানা সীমার ওপর। দুটি নির্বাচনেই বাবা-মেয়েকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা সাক্কু।
বিএনপি ছেড়ে প্রার্থী হওয়া কায়সারের ভাষায়, সাক্কু মেয়র হয়েছিলেন ‘বাহারের সমর্থনে’; আর বিষয়টি কুমিল্লার মানুষের কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’।
“আমি মনে করি সাক্কু আর রিফাত দুজনই এমপি বাহারের প্রার্থী। তারা দুইজন বাহারের শিষ্য,” বলছেন কায়সার।
তবে নৌকা প্রতীকের পক্ষের লোকজন বাহারের উপস্থিতিতে কোনো সমস্যা দেখছেন না।
রিফাতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাহার ভাই নির্বাচনের কোনো কাজে অংশ নিচ্ছেন না। তিনি তো একজন জনপ্রতিনিধি। ১৫ তারিখ পর্যন্ত তিনি কী এমপির দায়িত্ব পালন করবেন না? দায়িত্বের খাতিরেই তিনি কুমিল্লায় আছেন এবং থাকবেন।“
কুমিল্লার এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলছেন, ইসির নির্দেশের পরও সংসদ সদস্য বাহারের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থানের বিষয়টি তিনি ‘সংবাদ মাধ্যম থেকে’ জেনেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নের উত্তরে রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, “ইসি সচিবালয় থেকে সংসদ সদস্যকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এখন আপনাদের মাধ্যমে কমিশনও বিষয়টি জেনেছেন। কমিশন নিশ্চয়ই দেখবেন।”
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার সকালে সিইসিসহ আমরা সব নির্বাচন কমিশনার বসে আলোচনা করব। পরবর্তী পদক্ষেপ তখনই আপনাদের জানানো হবে।”
পুরনো খবর: