চাপ ছিল, প্রলোভনও ছিল: মসিউর

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার পর বিশ্ব ব্যাংকসহ ঋণদাতা সংস্থাগুলো দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশে চাকরির প্রলোভনও দেখিয়েছিল বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 May 2022, 02:03 PM
Updated : 29 May 2022, 03:21 AM

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ঠিক হয়ে যাওয়ার পর এক দশক আগের সেই কথা তিনি প্রকাশ্যে আনলেন আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে।

বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকার অর্থায়নে ২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরুর পর দুর্নীতির অভিযোগ তোলে বিশ্ব ব্যাংক।

তখন বিশ্ব ব্যাংকের চাপে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়, ছুটিতে যেতে হয় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসাইনকে। মামলাও হয়।

তখন পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজর মসিউর রহমানের পদত্যাগের শর্তও দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু তিনি রাজি হননি।

এরপর বিশ্ব ব্যাংক আর এই প্রকল্পে ফেরেনি; আর নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে কাজ শেষ করে আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন করতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু।

মসিউর রহমান। ফাইল ছবি

শুক্রবার রাতে ভার্চুয়াল ওই অনুষ্ঠানে সেসব ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর, যা আগে কখনও সামনে আসেনি।

তিনি বলেন, “আমার ওপরে যে চাপ ছিল যেমন, এখানে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ছাড়া অন্য যারা এতে অর্থায়ন করছে- বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, জাইকা- এরা একদিন সকালে আগে সময় ঠিক করে আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। প্রথমে তারা বলল যে, জাপানের অ্যাম্বাসির অফিসে।

“আমি বললাম, দেখো জাপান অ্যাম্বাসির অফিসে আমি যাব না। আমার নিজের কাছে যুক্তি ছিল যে, জাপানি অ্যাম্বাসির কাছে যদি আমি যাই, তাহলে যেটা মানুষের ধারণা হবে এবং প্রচার হবে- সেটা হলো, আমি বোধহয় তাদের কাছে নতজানু হয়ে কোনো একটা সুবিধা চাচ্ছি। জাপানি অ্যাম্বাসেডরকে বললাম, তুমি তাহলে আমার এখানে আস। জাপানি অ্যাম্বাসেডর বলল- ‘না, তোমার ওখানে গেলে সাংবাদিকদের ফেইস করতে হবে, আমি সাংবাদিকদের ফেইস করতে পারব না’। আমি বললাম, সাংবাদিকদের আমি ফেইস করব, তুমি আস।”

মসিউর রহমান বলেন, “ওরা এসে আমাকে বলল যে, আমাকে দায়িত্ব ত্যাগ করতে হবে, দেশও ত্যাগ করতে হবে। দেশত্যাগের শর্ত হলো তারা আমাকে বিদেশে বিশ্ব ব্যাংকে বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা কোথাও আমাকে একটা কনসালট্যান্সি জোগাড় করে দিবে এবং আমি যে বেতন চাই, সেই বেতনই তারা ব্যবস্থা করে দেবে। অথবা তারা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কিছু কাজ ঠিক করে দেবে এবং আমাকে তারা টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেবে।

“আমার উত্তর হলো দেখো, আমার যদি টাকা করার ইচ্ছা থাকত, তাহলে তোমরা যে দোষারোপ করছ, সেখানেই তো আমি টাকা করতে পারতাম। ওদের যেটা প্রস্তাব, এটা হলো একটা সামঞ্জস্যহীন প্রস্তাব। যে ‘দোষ’ করেছে, তাকে আবার তারা পুরস্কৃত করবে।”

সেসময় আওয়ামী লীগ নেতা ও বন্ধুরাও তাকে বিদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানান মসিউর।

তিনি বলেন, “যেটা আমার বলা উচিৎ হবে এবং না বলাটা অনুচিত হবে যে, এই শক্ত পজিশন নেওয়ার ক্ষমতাটা কোত্থেকে আসলো? বিশ্ব ব্যাংক বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কিছু গুরুজন স্থানীয়, যারা প্রভাবশালী, দু-একজন আমার বন্ধু, তারাও আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত- বন্ধু হিসেবে তারা আমাকে বলেছে যে, দ্যাখো তোমার নামে এসব ছড়াচ্ছে। তুমি কেন দায়িত্ব ত্যাগ করো না এবং দেশ ছাড় না কেন?

“আমি বললাম, আমি দেশ ছাড়ব না এইজন্য যে, দেশের বাইরে গেলে আমার পায়ের তলায় মাটি থাকবে না।”

‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাহস জুগিয়েছেন’ এ কথা বলতে বলতেই লাইভ অনুষ্ঠানে আবেগাপ্লুত হয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন মসিউর।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলে চলেন, “আমি যেটা বলি সেটা হল, আমার ওপর একটা বড় ছায়া আছে। সেই ছায়াটা হল- বঙ্গবন্ধুর ছায়া। ওই ছায়া যতদিন থাকবে, ততদিন আমি নিরাপদ।”

পদ্মা সেতু এখন যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত। ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু বেঁধেছে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীসহ মধ্যাঞ্চলকে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মসিউর বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও সৎ সাহস না থাকলে পদ্মা সেতু হত না।”

তিনি আরও বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট শেষ কর্মদিবসে এই ঋণ বাতিল করে দেন। ঋণের অনুমোদন দেয় বিশ্ব ব্যাংকের বোর্ড। বোর্ডকে নাকচ করার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের আছে কি না, এই একটা প্রশ্ন থাকতে পারে।”

পদ্মা সেতু প্রকল্পের শুরু থেকেই এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এই উপদেষ্টা বলেন, “পদ্মা সেতু শুরু হওয়ার আগে বা এই দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাংক সোচ্চার হওয়ার আগে যেটা অনুসরণ করা হতো- যে সংস্থা ঋণ দিয়েছে, প্রত্যেকে তাদের নিজের নিজের নিয়ম মেনে চলত।

“কিন্তু এইখানে বিশ্ব ব্যাংক- এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকা এদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে, যদি বিশ্ব ব্যাংক কোথাও দুর্নীতির জন্য কোনো সহায়তা বন্ধ করে তাহলে এরাও সে সহায়তা বন্ধ করবে। এরকম চাপ তারা সৃষ্টি করল। এই যে আন্তর্জাতিক মণ্ডলে চাপ সৃষ্টি- এর বিরুদ্ধে একটা পজিশন নেওয়া, এটা অত্যন্ত সাহসী না হলে সম্ভব হত না।”

পদ্মা সেতুর চালুর পর বাংলাদেশের উন্নয়ন কিভাবে ত্বরান্বিত হবে সে কথাও তুলে ধরেন তিনি।

মসিউর বলেন, “উন্নয়ন ততক্ষণ শুরু হয় না, যখন না মানুষের মনে উন্নয়ন স্পৃহা জাগে। দ্বিতীয়ত যতক্ষণ না তাদের এই আস্থা জাগে যে, উন্নয়ন শুধু স্বপ্ন না, উন্নয়ন তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে। আর এই বাস্তবায়ন সম্ভব হয় দেশের নেতৃত্ব ও নীতি যদি সঠিক পথে চলে। জনগণের আস্থা ও স্পৃহাই হলো সব থেকে বড় শক্তি। এই স্পৃহার এখনকার উৎস শেখ হাসিনা।”

বঙ্গবন্ধু সেতু যখন শুরু হয়, তখনও বিশ্ব ব্যাংক এটা ‘ভায়াবল’ হবে না বলে আপত্তি তুলেছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল যখন অনেক উন্নতি হবে, তখন বিশ্ব ব্যাংক আবার নিজে থেকেই ফিরে আসল।

“বঙ্গবন্ধু সেতু জাতীয় আয়ে ২ থেকে ৪ শতাংশ অবদান রাখছে, যেটা সমীক্ষার থেকেও বেশি।”

পদ্মা সেতু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প বাড়বে, মোংলা বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে এবং এশিয়ান হাইওয়ে সুবিধা ব্যবহার করে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ছাড়াও দেশের বাইরে যাওয়ার সুবিধা হবে বলে জানান তিনি।

“এর মানে হলো বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য ও বিশ্ব অর্থনীতির একটা কেন্দ্রে এসে গেল। এই কেন্দ্রের যে ক্ষমতা, সেটা অর্জনের জন্য আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। সেই কাজের উৎস হল, বিশ্বাস ও আস্থা, যেটা এই নেতৃত্বের কাছ থেকে পেয়েছি।”

এমন সেতু আগামী ৫০ বা ১০০ বছরেও আর একটি হবে না মন্তব্য করে মসিউর বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক একটি শতবর্ষী প্রকল্পের অংশীদার হওয়া থেকে নিজেকে বাদ দিয়েছে। বাংলাদেশ এককভাবে এই শতবর্ষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এটা দেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দেবে। এইটা একটা বড় অর্জন।“

পদ্মা সেতু নিয়ে যে ‘ষড়যন্ত্র’ সেটা ‘আপতদৃষ্টিতে’ কোনো ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

‘রাজনীতির সাতকাহন’ নামে আওয়ামী লীগের এ সাপ্তাহিক আয়োজনে সঞ্চালনা করেন দলের উপ-প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম; বক্তৃতা করেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক।