কূটনীতিক দায়িত্বে থাকাবস্থায়ই পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি, এক পর্যায়ে সরকারি পদ ছেড়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নিয়োজিত হন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে।
সাহিত্যের ছাত্র থেকে ঝানু আমলা ও রাজনীতিক হয়ে ওঠা মুহিতের মৃত্যুর পর সামনে আসছে উত্তাল সেই সময়ে তার ঐতিহাসিক ভূমিকার কথাও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এএমএ মুহিত মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তার এই অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ছিল না।
“তিনি সবসময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে লেখালেখি করেছেন, শত শত বক্তৃতা দিয়েছেন। তার চরিত্রের এই দিকটি আমাকে মুগ্ধ করে।”
সে সময় বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের ১৯টি দূতাবাসের ১১৫ জন বাঙালি কূটনীতিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে।
অনিশ্চিত জীবনের দিকে যাত্রা করে তাদের অনেকে সেই সময় বিদেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
সেই সময়ে কূটনীতিকদের পদত্যাগে আলোড়ন তৈরি হওয়ার কথা তুলে ধরে মহিউদ্দিন বলেন, “একজন রাষ্ট্রদূত বা এ ধরনের কূটনীতিক পদত্যাগ করেন, তখন ওই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মানুষজন চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে, হঠাৎ কী এমন ঘটল, এমন একটা গ্ল্যামারাস চাকরি ছেড়ে দিয়ে তারা রাস্তায় মিছিল করছে। কেন?
“নিশ্চয় বাংলাদেশে গুরুতর কিছু ঘটে যাচ্ছে, যে জন্য তারা এই ধরনের চরম একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। গ্ল্যামারাস জীবন ছেড়ে দিয়ে বউ- পোলাপান, তাদের অনিশ্চিত জীবনে ফেলে তারা কেন এটা করতেছে?”
এসব ঘটনা সেসময় সেসব দেশের সরকারের কাছে বড় পরিসরে পৌঁছানোর পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও পত্রপত্রিকায় ফলাও করেছে প্রচার হয়েছে বলে করেন সাবেক এই কূটনীতিক।
পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু পরপর চাকরিতে থাকাবস্থায়ই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
৩০ জুন আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের আগে থেকে তার ওই কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা উঠে এসেছে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের কথায় ও লেখায়।
১৯৯৬ সালে নিজের লেখা ‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’ বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজের ভূমিকা স্ববিস্তার লিখেছেন মুহিত।
মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন সরকার, জনগণ, বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীর ভূমিকা, আমেরিকার পত্রপত্রিকার ভাষ্য, বিশ্ব ব্যাংকের পদক্ষেপ, দাতাগোষ্ঠী ও জাতিসংঘের ভূমিকা উঠে এসেছে তার লেখায়।
তিনি লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধের আট মাস আমি মোটামুটিভাবে একজন কংগ্রেসনাল লবিস্ট ছিলাম এবং অনেক পরিচয় ও বন্ধুত্ব যা ঐ সময়ে হয় তা এখনও অটুট আছে।”
মুহিত লেখেন, “সাতাশে মার্চের পর পাকিস্তান দূতাবাসে থাকলেও আমি কাজ করেছি একান্তই বাংলাদেশের জন্য এবং বাঙালিদের জন্য। সরকারে অবস্থান কোনো কোনো ব্যাপারে বাঙালিদের কাজে লেগেছে। যেমন প্রশিক্ষণের মেয়াদ বাড়ানো, মার্কিন সাহায্যে গম বা সার খরিদ বন্ধ রাখা, বিশ্ব ব্যাংকের নানা প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি।
“তবে মে মাস থেকে দূতাবাসে কাজ করার খুব অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। ঔপনিবেশিক মাতৃভূমির ক্রীতদাস হিসেবে অথবা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে পরিচিতি আমার অসহ্য মনে হয়। ইতিমধ্যে জনমত গঠনে যারা অবদান রাখতে পারেন তেমন অনেক মার্কিন নেতা বা কর্মীবৃন্দের সঙ্গে হয় আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।”
পদত্যাগের আগে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মুহিতের কার্যক্রমের কথা স্মরণ করে সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুহিত সাহেব আনুষ্ঠানিকভাবে যদিও ৩০ জুন তারিখে পদত্যাগ করেন, তিনি কিন্তু বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আমেরিকা সফরকালে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে সহযোগিতা করেছিলেন। তার কোনো ভয়ডর ছিল না আর কি।”
প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদের লেখাতেও মুহিতের সেই সময়ের ভূমিকার কথা উঠে এসেছে।
কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি ওই সময়ে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফে পাকিস্তানিদের গণহত্যার ঘটনা তুলে ধরতে ভূমিকা রাখেন।
এ বিষয়ে ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ বইতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন, “প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে আসার অনেক আগে থেকেই তিনি (অধ্যাপক রেহমান সোবহান), এমএমএ মুহিত, হারুন-অর-রশীদ প্রমুখের সহযোগিতায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সমস্যার কবলে ফেলতে খুবই চেষ্টা করছিলেন।”
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মুহিত লেখেন, “মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এক মাস কি রকম একটি বাস্তবতা, উত্তেজনা ও ক্ষোভের মধ্যে পেরিয়ে গেল। অনিশ্চয়তা থাকলেও তা নিয়ে হা হুতাশ করার সুযোগ মিললো না। আশংকার প্রথম ইংগিত জ্যাকের সঙ্গে টেলিফোনালাপ কালে মিললো।
তিনি লেখেন, “সময়ের তফাতে মে মাসে আমি ছিলাম পাকিস্তান দূতাবাসের ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী কূটনীতিবিদ এবং জুলাইতে পাকিস্তান পরিত্যাগী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত লবিস্ট।”
মুহিতের ভাষায়, “যাতনার মাসের পরে আসে সঞ্চয়নের মাস। জুন-জুলাই ছিল আমেরিকায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সঞ্চয়নের সময়। জুন মাসে কংগ্রেসে পাকিস্তানকে সব রকমের সাহায্য বন্ধের জন্য সংশোধনী প্রস্তাব পেশ হল।”
একাত্তরের ২১ জুলাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে ‘ব্যক্তিগত বিদ্রোহের’ চিঠি পাঠানোর কথা তুলে ধরে মুহিত লেখেন, “তার অবৈধ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা একটি অসম্মানজনক অবস্থান বলে আমি তার সরকারের শ্রাদ্ধ করলাম। তাকে বাংলাদেশের গণহত্যা ও অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করলাম।”
ওই চিঠির কিছু অংশ পরবর্তীতে প্রকাশ করেছিল ওয়াশিংটন পোস্ট; যার শিরোনাম ছিল- ‘একজন কূটনীতিবিদের পদত্যাগ: পাকিস্তানের পাপের খতিয়ান’।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশনে ‘হোয়াই আই কুইট’ আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তৃতাও প্রচার হয়েছিল।
‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’ বইয়ের ভূমিকায় মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশের পাঁচটি যুগান্তকারী আন্দোলনে নিজের সম্পৃক্ততাকে ’গর্বের সঞ্চয়’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন ৮৮ বছর বয়সে শুক্রবার পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া মুহিত।
তিনি লিখেছেন, “আমার সৌভাগ্য যে, পাঁচটি যুগান্তকারী আন্দোলনের সংগে কোন না কোনরকমে সম্পৃক্ত ছিলাম। ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান হল তখন ছিলাম একজন সক্রিয় কিশোর। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছিলাম সক্রিয় ছাত্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধেও একজন পরোক্ষ সৈনিক হিসেবে ভূমিকা রাখার সুযোগ হয় প্রবাসে।
“১৯৯০-এর স্বৈরাচার উচ্ছেদ আন্দোলনেও তেমনি সোচ্চার ও সক্রিয় ছিলাম, এবারেও প্রবাসে নির্বাসনে। এই সেদিন গণতন্ত্র সমুন্নত করার প্রচেষ্টায় জনতার ডাকে অন্তত একাত্মতা জানাতে সক্ষম হই। এগুলো আমার গর্বের সঞ্চয়।”