সংবিধান পর্যালোচনার প্রস্তাব মেনন-ইনুর

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পেরিয়ে দেশের সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন দেখছেন দুই বাম নেতা রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু।

সাজিদুল হক সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2022, 05:42 PM
Updated : 26 Jan 2022, 05:42 PM

বাংলাদেশের সংবিধান

বুধবার সংসদে তারা সেই প্রস্তাব তুলে শাসনতন্ত্র পর্যালোচনার জন্য বিশেষ একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ জানিয়েছেন।

প্রধানত সামরিক শাসনের সময়ে সংবিধানে যেসব বিষয় ঢোকানো হয়েছে, তা বাদ দেওয়া এবং ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছেন তারা।

আওয়ামী লীগের জোট শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদের দুই শীর্ষ নেতার এই প্রস্তাবের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, এই মুহূর্তে সংবিধান সংস্কারের কোনো ভাবনা তাদের নেই।

স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের পর এ পর্যন্ত ১৭ বার তাতে পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী আদালতের রায়ে খারিজ হয়ে যায়। এ নিয়ে সরকারের পুনর্বিবেচনার আবেদন (রিভিউ) আদালতে রয়েছে এখনও।

ষোড়শ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে আনা সপ্তদশ সংশোধনীতে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখা হয়।

তার আগে ২০১১ সালে আনা পঞ্চদশ সংশোধনে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আসে সংবিধানে। ওই সংশোধনে বিলুপ্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যোগ হয়েছিল ওই সংশোধনে।

রাষ্ট্রের নাগরিকদের জাতীয়তা বাংলাদেশির পরিবর্তে বাঙালি করা হয় পঞ্চদশ সংশোনীতে। ৭২’র সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ওই সংশোধনের আগে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে চেয়ারম্যান এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে (বর্তমানে প্রয়াত) কো-চেয়ারম্যান করে যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি হয়েছিল, তাতে মেনন ও ইনুও সদস্য ছিলেন।

তখন রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ‘বিসমিল্লাহ’ না রাখা, আদিবাসীদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে অবস্থান ছিল মেনন ও ইনুর। কমিটির বৈঠকে কিছু বিষয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক আপত্তিও ছিল, কিন্তু সেগুলো তখন আমলে নেওয়া হয়নি।

তার এক দশক পর বুধবার সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় দাঁড়িয়ে তারা সংবিধান পর্যালোচনার জন্য আবারও বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব তোলেন।

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। ফাইল ছবি

জাসদ সভাপতি ইনু বলেন, “বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথ চলার জন্য স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে সংবিধান পর্যালোচনা করা দরকার। সংবিধান পর্যালোচনা ও সংস্কার করা দরকার। সেজন্যই সংবিধান পর্যালোচনার জন্য সংসদের বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করছি।”

সংবিধানের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন চান, জানতে চাইলে ইনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সময়ের অভাবে সংসদে বিস্তারিত বলতে পারিনি। আমি যেটা বলতে চাই, তা হল, আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার জন্য আমাদের সংবিধান সংস্কার করা দরকার।

“সামরিক আমলে সংবিধানে যেসব বিষয় প্রবেশ করানো হয়েছিল, তার আংশিক এখনও রয়ে গেছে। সেগুলো বাদ দিতে হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

“৭০ অনুচ্ছেদের পর্যালোচনা করতে হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় পর্যালোচনা করতে হবে। অর্থাৎ, নিয়োগের ব্যাপারে তাকে আরও ক্ষমতা দেওয়া উচিৎ। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা পর্যালোচনা করতে হবে,” বলেন তিনি।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা বহু দিনের। এই অনুচ্ছেদের কারণে কোনো সংসদ সদস্য অনাস্থা ভোটসহ কোনো ক্ষেত্রেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিতে পারেন না।

এতে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে বলে যেমন মত রয়েছে; আবার এই মতও রয়েছে যে বাংলাদেশের বাস্তবতায় ওই নিয়ন্ত্রণ থাকাটা প্রয়োজন।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি মেনন সংসদে বলেন, “বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, তা সংসদীয় ব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার আমলেই সংবিধানের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনী সংবিধানের মৌল বিষয়েরই পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। আর সামরিক শাসকরা নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে আর পাকিস্তান আমলের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে ওই সংবিধানকে ভোতা ছুরি দিয়ে জবাই করেছিল।

“দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীতে সেই সংবিধানের মৌল চরিত্র কিছুটা ফিরিয়ে আনলেও এমন সব বিধি বর্তমান, যা সরকার পরিচালনায় প্রধান নির্বাহীর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সংবিধানকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছে।”

রাশেদ খান মেনন। ফাইল ছবি

বিএনপির আমলে দ্বাদশ সংশোধনীর প্রসঙ্গে টেনে তখনও সংসদে থাকা মেনন বলেন, “রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান এবং সংসদীয় ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার ‘নম্বর ওয়ান এবং দি ইকুয়াল’ এই ব্যবস্থায় ফিরে আসার জন্য দেশের তৎকালীন বিরোধীদলের উপনেতা, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আবদুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে আমাদের প্রস্তাবগুলো মানেনি।

“সেই সময়ের বিএনপির মূল নেতাদের অন্যতম বর্তমানে এলডিপির সভাপতি কর্নেল অলি আহমদ সম্প্রতি এই জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন।”

মেনন বলেন, “সংবিধানের ৭০ বিধি সংশোধন করে সংসদ সদস্যদের মত প্রকাশের অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও তারা মানেনি। যার ফলে সংসদ সদস্যরা স্বাধীন মত ব্যক্ত করতে পারেন না। অন্যদিকে রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে এরশাদের বিধির কিছু সংশোধন করে বহাল রাখায় ধর্মবাদীরা আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করার, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন করার জন্য দাবি তুলছে।

“সংবিধানে আদিবাসীদেরও ‘আদিবাসী’ হিসাবে স্বীকার না করায় আদিবাসীরা নিজেদের ‘পরিচয়হীন’ মনে করছে।”

এসব ছাড়াও সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, মানবাধিকার বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করতে সংবিধানের পর্যালোচনা ‘বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে’ বলে মনে করেন তিনি।

এজন্য সংসদের আগামী অধিবেশনে সংবিধানের পর্যালোচনার জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সদস্যদের নিয়ে বিশেষ কমিটি গঠনের জন্য সংসদ নেতা শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন তিনি।

পরে মেনন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার প্রয়োজন। সংসদ সদস্যরা সব কথা বলতে পারেন না। এটা আমরা সবসময় বলে আসছি।”

রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সাম্যের কথা আমি বক্তব্যেই বলেছি। এখানে একটা সামঞ্জস্য রাখা দরকার, যেটা দ্বাদশ সংশোধনীর সময় প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সেটা রাখেনি। এগুলো নিয়ে এখন আবার কথা বলার সময় এসেছে।”

মেনন জানান, সংসদের পরের অধিবেশনে এ বিষয়ে একটি বেসরকারি বিল বা সিদ্ধান্ত প্রস্তাব তিনি উপস্থাপন করবেন।

সংবিধান সংশোধন নিয়ে সরকারের ভাবনা কী, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের (মেনন-ইনু) বক্তব্য আমি শুনেছি। তারা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সরকার এখনও এ বিষয়ে কিছু ভাবেনি।”