ইসি গঠনের বিলে দুই পরিবর্তনের সুপারিশ

সংসদে উত্থাপিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের যোগ্যতা-অযোগ্যতার অংশে দুটি পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2022, 09:49 AM
Updated : 24 Jan 2022, 01:24 PM

সোমবার সংসদ ভবনে কমিটির বৈঠকে বিলটি নিয়ে আলোচনা শেষে সংসদে দেওয়ার জন্য প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়। আগামী বুধবার সংসদ অধিবেশনে কমিটির এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।

বৈঠক শেষে সংসদীয় কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার সাংবাদিকদের বলেন, “কমিটি বিস্তারিত আলোচনা করে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। আমরা যোগ্যতা ও অযোগত্যার জায়গায় কিছু পরিবর্তন এনেছি। সেভাবেই সংসদে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।”

বহুল আলোচিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ রোববার সংসদে উত্থাপন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।

যে পরিবর্তনের সুপারিশ

সংসদে উত্থাপিত বিলে সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা সংক্রান্ত ৫(গ) ধারায় বলা আছে, সিইসি ও কমিশনার হতে গেলে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

এই ধারায় সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য পেশা’ যুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

আর অযোগ্যতার ক্ষেত্রে ৬ (ঘ) ধারায় বলা আছে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সিইসি ও কমিশনার হওয়া যাবে না।

এখানে দুই বছরের কারাদণ্ড উঠিয়ে দিয়ে শুধু কারাদণ্ডের সুপারিশ করেছে কমিটি। অর্থাৎ, নৈতিকস্খলন ফৌজদারি অপরাধে যে কোনো মেয়াদের সাজা হলেই সিইসি বা কমিশনার হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগত্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে জানান শহীদুজ্জামান সরকার।

সংসদে উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে আগের সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশনকে ‘বৈধতা’ দেওয়া হচ্ছে বলে যে আলোচনা রয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, “ইনডেমনিটি বলছে অনেকে। ইনডেমনিটি নয়। বিলের নয় দফায় কিন্তু আগের দুটো সার্চ কমিটির বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ওই দুই সার্চ কমিটিকে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়েছে।”

“একটা লিগ্যাল সাপোর্ট দেওয়া। সার্চ কমিটি রাষ্ট্রপতি ঐক্যমতের ভিত্তিতে করেছিল। সেটাকে সাপোর্ট দেওয়া হল। কোনো দায়মুক্তি নয়। আর আইনটা কিন্তু নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে। সার্চ কমিটির আইন নয়।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আগের দুটো কমিশনের কার্যক্রমকে হেফাজত দেওয়ার বিষয় এখানে আসেনি। শুধুমাত্র সার্চ কমিটির বৈধতা দেওয়া হয়েছে।”

সংসদে উত্থাপিত বিলে বলা হয়েছে, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদানের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ইতোপূর্বে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির ও তৎকর্তৃক সম্পাদিত কার্যাবলি এবং উক্ত অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বৈধ ছিল বলিয়া গণ্য হইবে এবং উক্ত বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।”

আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য বিএনপির রুমিন ফারহানা কমিটির বৈঠকে বিলটিতে কিছু সংযোজনীর প্রস্তাব করেন। তবে তার প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়নি।

রুমিন ফারহানা সাংবাদিকদের বলেন, তিনি বৈঠকে বলেছেন, আইনটির খসড়া নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে ‘কোনো আলাপ আলোচনা করা হয়নি’। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি সার্চ কমিটি গঠনের জন্য যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিলেন তার সঙ্গে এই খসড়ার কোনো পার্থক্য নেই। যে কারণে অনেকে এটাকে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আইন বলছেন।

“সার্চ কমিটি কাদের নাম প্রস্তাব করল সেটা প্রকাশ করতে হবে, তার ওপর আলোচনা হবে, তারা আসলেই যোগ্য কী না, সে ব্যাপারে আইনে কিছু বলা হয়নি। আইনের ৯ ধারায় ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে। এটা আইনের ‘বেসিক কনসেপ্টের’ পরিপন্থি। রেস্ট্রোসপেকটিভ ইফেক্ট দেওয়া আইনের চোখে কখনো ভালো চোখে দেখা হয় না।”

কমিটির বৈঠক শেষে সংসদের ফটকে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে কী পরিবর্তন হয়েছে, সেটা আমি এখানে বলছি না। এটা সংসদ আগে জানার অধিকার রাখে। আমি যেদিন বিলটি সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করব সেদিনই বিলটির পরিবর্তন সম্পর্কে বলব।”

কমিটির অন্য সদস্য জাপার সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, “দুটো বিষয় বাতিল হয়েছে। আগে নৈতিকস্খলনজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছরের যে ব্যারিয়ার ছিল সেটা বাতিল হয়েছে। এখন যে কোনো মেয়াদে সাজা হলেই সে আর সিইসি বা ইসি হতে পারবেন না। আর হল স্বায়ত্বশাসিত ও পেশাজীবীদের থেকেও নেওয়া যাবে।”

শহীদুজ্জামান সরকারের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান, মো. শামসুল হক টুকু, মো. আব্দুল মজিদ খান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার, রুমিন ফারহানা এবং সেলিম আলতাফ জর্জ অংশ নেন।

আইনের প্রেক্ষাপট

১৭ জানুয়ারি বঙ্গভবনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপ।

নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন এবং সার্চ কমিটি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য বিলটি রোববার সংসদে তোলা হয়।

কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের বিদায় লগ্নে আকস্মিকভাবে নতুন আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এখন সংসদে বিল পাসের উদ্যোগ এল সরকারের পক্ষ থেকে।

যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গেল ডিসেম্বরে ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শুরুর আগে বলেছিলেন, ‘সময়ের স্বল্পতার কারণে’ এবার আইন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সংলাপে অংশ নেওয়া সব দলই আইন করার পক্ষে জোরালোভাবে দাবি জানালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

গত সোমবার প্রস্তাবিত আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। তারপর এবারের অধিবেশনেই তা উত্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। এর আগেই নতুন কমিশন গঠন করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। এক্ষেত্রে আইনটি সংসদে তোলা থেকে পাস করে গেজেট প্রকাশের জন্য হাতে সময় রয়েছে চার সপ্তাহ।

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, সাংবিধানিক সংস্থা ইসিতে কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। আর তা একটি আইনের অধীনে হবে। এতদিন সেই আইন না হওয়ায় প্রতিবারই ইসি গঠনের সময় শুরু হয় বিতর্ক।

তা এড়াতে ২০১২ সালে নতুন কমিশন নিয়োগের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সার্চ কমিটি নামে একটি মধ্যস্থ ফোরাম তৈরি করেন, যেটি নিয়েও পড়ে বিতর্ক হয়।

এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিকদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করেন।

ওই সার্চ কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যদের নামের একটি তালিকা তৈরি করেন। সেই তালিকা থেকে একজন সিইসিসহ অনধিক পাঁচজন কমিশনার নিয়োগ দেন।

এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন। এবারও একই পদ্ধতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

কিন্তু সংলাপে অংশ নেওয়া ২৫টি দলের প্রায় সবগুলো ইসি গঠনে স্থায়ী সমাধান হিসেবে আইন প্রণয়নের উপর জোর দেয়। আলোচনায় রাষ্ট্রপতিও এ বিষয়ে সম্মত হন বলে দলগুলোর নেতারা জানান।

বিএনপিসহ সাতটি দল অবশ্য সংলাপে অংশ নেয়নি।