ইউপিতে নৌকার হার, কী ভাবছে আওয়ামী লীগ?

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের ছয়টিতেই স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী জিতেছেন; নৌকার প্রার্থী জয়ী হয়েছে কেবল একটিতে।

মঈনুল হক চৌধুরীও কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2021, 06:30 PM
Updated : 1 Dec 2021, 11:48 AM

স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন, এমন ছয়টি ইউনিয়নের তিনটিতে দ্বিতীয় অবস্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা; বাকি তিনটিতে দ্বিতীয় অবস্থানেও নেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী।

নিজেদের ‘ঘাঁটি’তে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের এমন ভরাডুবি নিয়ে কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুরাদ কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বিদ্রোহীদের দমাতে পারিনি। বিদ্রোহীদের অনেকে ইন্ধন দিয়ে থাকতে পারে।”

তার ভাষ্য, উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল এক নেতার ভাই একটি ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় অন্যদের বোঝাতেও সমস্যা হয়েছে।

“সাধারণ সম্পাদকের ভাই একটি ইউপিতে বিদ্রোহী হওয়ায় অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়েছে হয়ত। ওকে অফ করতে পারলে অন্যরাও শুনত। তারা আমাকে প্রশ্ন করছে, আমিও কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। আমরা অফিসিয়ালি বহিষ্কার করেছি, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের দমাতে পারিনি।”

আওয়ামী লীগের ‘ঘাঁটিতে’ বিদ্রোহীদের কারা ইন্ধন দিচ্ছে, তা খুঁজে বের করার অনুরোধ করেন উপজেলা সভাপতি।

আবার যে জরিপের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, সেই জরিপের তথ্য সঠিক নাও হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

মুরাদ বলেন, “আমরা দলের ভেতরে বিভেদের কারণে ফেল করেছি। নৌকার শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করেছি, কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে তা করতে পারলাম না।”

এই অবস্থায় স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়ার পক্ষপাতি উপজেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা।

“প্রতীক একজনকে দিলে অন্যরা অসন্তুষ্ট হয়,” মন্তব্য করেন তিনি।

আবার দলীয় প্রার্থীর হারের জন্য কালিয়াকৈর উপজেলা সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করীম রাসেল দেখছেন নেতৃত্বের দুর্বলতা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ উপজেলায় সব ইউনিয়নই তো বলতে গেলে বিদ্রোহীরা নিয়ে গেল। আওয়ামী পরিবারকে ঐক্যবদ্ধ রাখার দায়িত্ব যাদের, তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে আজ নৌকার পরাজয় হয়েছে।”

তিনি দাবি করেন, সব ইউনিয়নে গিয়ে নৌকার প্রার্থীদের পক্ষেই ভোট চেয়েছেন তিনি।

 “বিদ্রোহীদের বহিষ্কারে আমিই প্রথম স্বাক্ষর করেছি। নীতি নির্ধারকরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে।”

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন আটটিতে। মাত্র একটিতে জিতেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। এখানে দ্বিতীয় অবস্থানে ছয়জন নৌকার প্রার্থী।

নবাবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে জামায়াত-বিএনপি এক হয়ে নৌকার এগেইনেস্টে যে ভোট পায়, এটা প্রমাণ করে দিল। আমাদের ভোট কমছে তা তো নয়, বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন না করলেও তাদের ভোট রয়েছে; তাদের ভোটগুলো বিদ্রোহীদের মধ্যে যার সম্ভাবনা তার পক্ষে হয়ে গেল।”

শনিবার তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ৭৪ শতাংশ ভোট পড়েছে; যাদের ভোটে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের ৫২৫ জন এবং স্বতন্ত্র ৪৪৬ প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন।

এ ধাপের ভোটে অন্তত শতাধিক ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন না।

এই পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ জরুরি বলে মনে করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর।

“কী কারণে কেন নৌকার প্রার্থী হারল, এটা আর আমাদের বলতে হবে না। অটোমেটিক জেনে যাবে কেন্দ্র। সব জায়গাতেই একই ঘটনা, বাংলাদেশেই একই চিত্র।”

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

কেন্দ্রের ভাবনা কী?

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম মনে করেন, স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট দেওয়ার ‘অভ্যাসটা’ এখনও গড়ে ওঠেনি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্থানীয় প্রতীকে দীর্ঘদিন দিনের প্র্যাকটিস। কিন্তু দলীয় প্রতীকে ভোট দেওয়ার অভ্যাসটি এখনও গড়ে উঠেনি। এজন্য স্থানীয় প্রভাবটা রয়ে গেছে এখনও।”

আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, “বিদ্রোহী হওয়ার প্রবণতাও রয়েছে।

“বড় দলের ক্ষেত্রে অসংখ্য যোগ্য নেতা রয়েছে আওয়ামী লীগে, ত্যাগী নেতাও রয়েছে। মনোনয়ন চান ৪/৫ জন, পান একজন। সেখানে নতুন একটা সমীকরণ দেখতে পাচ্ছি-যিনি দলীয় মনোনয়ন পান তার বিপক্ষে অনেকে যারা মনোনয়ন পান না, তারা সবাই মিলে প্রার্থীর বিপক্ষে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।”

বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে কড়া বার্তা দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, অনেককে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে নামা ঠেকানো যায়নি।

বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও ভোটের মাঠে থেকে নৌকার প্রার্থীদের বিরোধিতা করেছিল বলেও দাবি করেন নাছিম।

তিনি বলেন, “নির্বাচন তো প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ মাঠে, গোপনে বিএনপি-জামায়াতও নির্বাচন করছে মার্কার বাইরে।

“বিএনপি-জামায়াত যেখানে তাদের প্রার্থী নেই, সেখানে তারা কিন্তু আমাদের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে দলের ঐক্যকে নষ্ট করার একটি ভিন্ন ধরনের কৌশলী অবস্থান নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের ভেতরে বিভেদ সৃষ্টি করার এটা একটা অপকৌশল।”

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার পরাজয় আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতার প্রকাশ হিসেবে দেখাচ্ছেন বিএনপি নেতারা।

তবে আওয়ামী লীগ নেতা নাছিম তা মানতে নারাজ।

“স্থানীয় নির্বাচনের এ প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে থাকবে না। কেটে যাবে এটা। আওয়ামী লীগের ঐক্য নষ্ট করতে পারবে না তারা,” বলেন তিনি।