দল থেকে বহিষ্কার: জাহাঙ্গীরের মেয়র পদের কী হবে

বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচনায় থাকা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে আওয়ামী লীগ দল থেকে বহিষ্কারের পর এবার আলোচনা চলছে তার মেয়র পদের ভবিষ্যত নিয়ে।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2021, 07:23 PM
Updated : 25 Nov 2021, 09:58 AM

দলীয় প্রতীকে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরুর পাঁচ বছর পর এই প্রথম কোনো মেয়রকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটল।

এখন প্রশ্ন হল, ২০১৮ সালের জুনে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হওয়া জাহাঙ্গীর দলীয় প্রাথমিক সদস্য পদ হারানোর পর মেয়রের চেয়ারে থাকতে পারেন কি না?

তাৎক্ষণিকভাবে এর স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে এটা নতুন অভিজ্ঞতা। আইন দেখে আলোচনা করে তবেই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে জাহাঙ্গীরের একটি মন্তব্যের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তোলপাড় শুরু হয়। ওই অডিওতে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে মন্তব্য করতে শোনা যায় তাকে।

সে সময় জাহাঙ্গীরকে কারণ দর্শাও নোটিস দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, তিনি তার উত্তরও দিয়েছিলেন। সেই উত্তর পর্যালোচনার পর শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আসে।

এখন জাহাঙ্গীর মেয়র পদে থাকতে পারেন কি না- সেই আইনগত বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা মুখপাত্র যিনি আছেন, তিনি বলবেন; আমি জানি না।“

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়েও জানানো হবে।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনমন্ত্রী বলেন, “স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, এ নিয়ে আমি কমেন্ট করতে চাই না।“

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তো আমি শুনিনি। উনি দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন, দলীয়ভাবে বহিষ্কার করলে এখন কী হবে তা আইনগত বিষয়।”

বিষয়টি দেখে পদক্ষেপ নিতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “উনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। দল থেকে বহিষ্কার করেছে, তিনি তো দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত। এটা আমাদের নতুন অভিজ্ঞতা। এ আইনগত দিক আলাপ আলোচনা করে কাজ করতে হবে।”

সচিব জানান, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল হলে মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে। 

জাহাঙ্গীরের ক্ষেত্রে এখনও সেরকম কিছু হয়নি, ফলে বিষয়টি ‘তলিয়ে দেখে’ তারপর ব্যবস্থা নিতে হবে।

আইন কী বলে?

সিটি করপোরেশন আইনেও এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট করতে ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করা হয়। তখন শুধু দলীয় প্রতীক ও প্রার্থিতার বিষয়টি যুক্ত করা হয়। মেয়র পদ থেকে অপসারণের বিষয়ে নিয়মের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে ‘মেয়র ও কাউন্সিলরগণের সাময়িক বরখাস্তকরণ’ অংশে বলা হয়েছে-

>> ১২ (১) সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হলে সরকার লিখিত আদেশের মাধ্যমে ক্ষেত্রমত মেয়র বা কোনো কাউন্সিলরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে পারিবে।

 >> ১২ (২) উপ-ধারা (১) এর অধীনে সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়রকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হলে সেই আদেশপ্রাপ্তির তিন দিনের মধ্যে সাময়িকভাবে বরখাস্ত মেয়র, ক্রমানুসারে মেয়র প্যানেলের জ্যেষ্ঠ সদস্যের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন।

মেয়রের বিরুদ্ধে আনা আইনি কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত, অথবা সেই মেয়র অপসারিত হলে, তার পরিবর্তে নতুন মেয়র নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র সাময়িকভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

মেয়র এবং কাউন্সিলরদের অপসারণের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে-

>> ১৩ (১) মেয়র অথবা কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন, যদি তিনি-

 (ক) যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন; অথবা

 (খ) নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে আদালতে দণ্ডিত হন;

 (গ) দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন;

 (ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন;

 (ঙ) নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হয়;

 (চ) বার্ষিক ১২টি মাসিক সভার পরিবর্তে ন্যূনতম ৯টি সভা গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অনুষ্ঠান করতে, বা ক্ষেত্রমত, সভায় উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হন।

এখানে ‘অসদাচরণ’ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, এ আইন অনুযায়ী বিধি-নিষেধ পরিপন্থি কার্যকলাপ, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য দেওয়াকে বোঝাবে।

অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিধি অনুযায়ী তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।

সিটি করপোরেশনের কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরকে পদ থেকে অপসারণ করা হলে, ওই আদেশের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করতে পারিবেন এবং আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপসারণের আদেশ স্থগিত থাকবে।

সব পক্ষকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ওই অপসারণের আদেশ পরিবর্তন, বাতিল বা বহাল রাখতে পারিবেন। আপিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

অপসারিত কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কার্যকালের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন না।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক মনে করেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দল থেকে বহিষ্কার হলে মেয়র পদেও থাকতে পারবেন না।

জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ার পর দল থেকে বহিষ্কার করলে মেয়র পদে তো আর থাকবার সুযোগ নেই। কারণ, দলে তো উনি আর নেই, তাহলে দল থেকে বহিষ্কার করলে তো আর (মেয়রের) চেয়ার থাকে না। এটা সাধারণ হিসেব।”

মেয়র জাহাঙ্গীর আলম

অভিজ্ঞতা কী বলে?

দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত কোনো সিটি মেয়রের দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ঘটনা নিয়ে এমন জটিলতা আগে দেখা যায়নি। ফলে বিষয়টি নির্ভর করবে আইনি ব্যাখ্যার ওপর।

স্থানীয় সরকারে এ ধরনের ঘটনা না ঘটলেও সংসদে এরকম সমস্যা আগেও হয়েছে। অবশ্য সংসদের ক্ষেত্রেও আইনে স্পষ্ট কিছু নেই।

হজ নিয়ে এক মন্তব্যের পর ২০১৪ সালে পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে প্রথমে মন্ত্রিসভা থেকে এবং পরে আওয়ামী লীগ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

এরপর তিনি সাংসদ পদে থাকতে পারেন কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছিল তখন।

সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিষয়ে সংবিধানের ৭০ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনও নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেন তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে।

ওই অনুচ্ছেদে দল থেকে বহিষ্কৃত হলে সদস্য পদের কী হবে, সে বিষয়ে কিছু বলা নেই; ফলে লতিফ সিদ্দিকীর বেলায় জটিলতা দেখা দেয়।

বহিষ্কারের আট মাস পর বিষয়টি জানিয়ে স্পিকারকে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর সংবিধান, মেম্বার অফ পার্লামেন্ট (ডিটারমিনেশন অব ডিসপিউট) অ্যাক্ট, সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধি ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ মেনে বিতর্ক নিষ্পত্তির কার্যক্রম নেওয়া হয়। লতিফের সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না, তা মীমাংসার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন।

ইসি তখন শুনানির উদ্যোগ নেয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং লতিফ সিদ্দিকীকে লিখিত বক্তব্য দিতে বলা হয়। লতিফ এর বিরুদ্ধে আদালতে গেলেও তার আবেদন খারিজ হয়ে যায়। তিনি তখন ইসির শুনানিতে গিয়ে বলেন, তিনি নিজেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করছেন, শুনানির আর দরকার নেই।

লতিফ সিদ্দিকী নিজেই পদ ছেড়ে দেওয়ায় সে সময় সমস্যা মিটলেও এ বিষয়ে আইনি ব্যাখ্যা আর স্পষ্ট হয়নি।

সিটি করপোরেশনের মেয়রদের ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতা তৈরি না হলেও ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালত আমলে নেওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বেশ কয়েকজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তাদের কেউ কেউ আবার উচ্চ আদালতের আদেশ নিয়ে চেয়ারেও ফিরেছেন। 

গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের ওই বক্তব্য নিয়ে কোনো মামলা এখনও হয়নি। পুরনো কোনো মামলায় চার্জশিট হওয়ার ঘটনাও তার ক্ষেত্রে নেই।

শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, আইনগত কোনো ব্যবস্থা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কি না।

উত্তরে কাদের বলেন, “সে ব্যবস্থাও (আইনগত) নেওয়া হতে পারে। যেহেতু তার বক্তব্য বঙ্গবন্ধু ও আমাদের ইতিহাসকে কটাক্ষ করে। কাজেই এটা প্রশাসনিকভাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আজকের দলীয় সিদ্ধান্ত অফিসিয়ালি জানানো হবে।”