ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীতে নাকাল আওয়ামী লীগ

ভোটের আগে সংঘাতে আহত হলেন শরীয়তপুরের রুদ্রকর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী সিরাজুল ইসলাম ঢালী। সংঘর্ষে অন্য পক্ষে থাকা আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী হাবিবুর রহমান ঢালীও আওয়ামী লীগই করেন। দলের মনোনয়ন না পেয়ে প্রার্থী হয়েছেন তিনি, যাকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দেখা হয় দেশের রাজনীতিতে।

কাজী মোবারক হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Nov 2021, 06:13 PM
Updated : 9 Nov 2021, 06:13 PM

পিরোজপুরের শংকরপাশা ইউনিয়নে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হলেন পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল মাহবুব শুভ। এই হামলার জন্য যাকে দায়ী করা হচ্ছে, সেই নাসিরউদ্দিন মাতুব্বরও সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী, তিনি জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ না নেওয়ার মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক পাওয়া প্রার্থী আর বিদ্রোহী প্রার্থীর এমন সংঘাত চলছে প্রায় গোটা দেশজুড়ে।

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নে সোমবার সকালেই সংঘর্ষে নিহত হলেন দুই ভাই। এই সংঘাত দুই ইউপি সদস্য প্রার্থীর মধ্যে হলেও তারা দুজনই আওয়ামী লীগই করেন।

১১ নভেম্বর ও ২৮ নভেম্বর দুই ধাপে প্রায় দুই হাজার ইউপিতে প্রার্থী হওয়া আওয়ামী লীগের নেতাদের সমর্থকদের এমন সংঘর্ষে গত এক সপ্তাহে ছয়জনসহ এক মাসে এক ডজনের বেশি মানুষ মারা গেছে। এই সহিংসতা দেখে বিব্রত হওয়ার কথা জানিয়েছেন খোদ সিইসি কে এম নূরুল হুদা। সহিংস ঘটনা নিয়ন্ত্রণে বৈঠকও ডাকে ইসি।

ভোটে না যাওয়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই সহিংসতা দেখিয়ে সম্প্রতি বলেন, “তারা নিজেরা নিজেরা এখন মারামারি করে। কারণ বিরোধী দল তো নাই।”

বিএনপি দলীয় প্রতীকে অংশ না নিলেও দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করার কৌশল নিয়েছে- এমন কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বলে এলেও ইউপিতে নিজেদের কোন্দল থামাতে দৃশ্যত হিমশিম খাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের থামাতে কড়া কড়া হুঁশিয়ারি দিলেও তাদের মানানো যাচ্ছে না। এতে যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ‘গভীর উদ্বিগ্ন’ তার প্রকাশ ঘটছে সম্প্রতি তৃণমূল পর্যায়ে দেওয়া এক চিঠিতে।

গত সপ্তাহে পাঠানো ওই চিঠিতে ওবায়দুল কাদের লিখেছেন, “গভীর উদ্বেগের বিষয় এই যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সৃষ্টিতে লিপ্ত রয়েছেন। বিষয়টি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।”

এই পরিস্থিতিতে ইউপিতে দলীয় প্রার্থী না রাখলে সংঘাত এড়ানো যাবে বলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে কারও কারও মত।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর প্রয়াত সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে সাংসদ তানভীর শাকিল জয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকলে কোন্দল, সংঘাত ঠেকানো সম্ভব। প্রতীক না থাকলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা খুশি হবে।”

আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টানা এক যুগ ক্ষমতায় থাকায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব বেড়েছে, আবার বিভিন্ন এলাকায় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় নেতাদের বিরোধও রয়েছে, এসবের কারণে ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থী বেশি হয়েছে।

এর আগে বিভিন্ন সময় সংসদ সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধের মধ্যে তাদের মধ্যে সীমারেখা টেনে দিতে দেখা গেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে।

বিদ্রোহী প্রার্থীদের যে অনেক সংসদ সদস্য মদদ দিচ্ছেন, তেমন তথ্যও পেয়েছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

আবার বিএনপি ভোটে না থাকায় একতরফা ভোটের সমালোচনা এড়িয়ে নির্বাচনের জৌলুস দেখাতে দলের মধ্য থেকেও বেশি প্রার্থী হওয়াকে উৎসাহিত করা হয়েছে, এমন আলোচনাও রয়েছে।

গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের কয়েকটি ইউপিতে কাউকে নৌকা প্রতীক না দিয়ে উন্মুক্ত করে দেওয়ার ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের কথায় তারই সমর্থন পাওয়া গেল।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেখানে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা সহজে পাস করবে। যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে আসে নাই এবং আওয়ামী লীগের ভোট বেশি, সেই বিবেচনায় এই জায়গাগুলোতে দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়নি।

“তাছাড়া অনেক প্রার্থীদের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নির্বাচন জমজমাট হবে, নির্বাচন কমিশনও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারবে, সেই বিবেচনায় এই কয়েক জায়গায় প্রতীক দেওয়া হয়নি।”  

আবার বিদ্রোহী প্রার্থী হলে বহিষ্কারের ঘোষণা থাকলেও ইতোপূর্বে বিভিন্ন সময় জয়ী বিদ্রোহী প্রার্থীদের দলে টেনে নেওয়ার নজিরও দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করতে উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেই মত রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে কড়া হুমকি দেওয়ার পরও কাজ না হওয়ায় এক ধরনের অসহায়ত্বই ফুটল আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের কথায়।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা বিদ্রোহ করছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ইতোমধ্যে কয়েক জায়গায় হয়েছেও। বিদ্রোহী বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও আমরা তাকে আর মনোনয়ন দিচ্ছি না, দল থেকে বহিষ্কার হচ্ছে। এখন দলের বাইরে গিয়ে যদি কেউ নির্বাচন করে, তাহলে তো আর করার কিছু নেই।”

স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে নিচের ধাপে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ; এই নির্বাচনে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হয়। ইউপি সদস্য পদে ভোট হয় নির্দলীয়ভাবে।

আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী ঠিক হয় প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন বোর্ডের সভায়। তার আগে তৃণমূল পর্যায় থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামের সুপারিশ আসে।

বিদ্রোহের তোড়ে স্বতন্ত্র বেশি

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় তৃতীয় ধাপে ১০০৩ ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৫ হাজার ২৮৫ জনের মনোনায়নপত্র জমা পড়েছে। স্বতস্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা দলীয় প্রার্থীর দ্বিগুণ।

এর মধ্যে ২০টি রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থী হয়েছেন ১,৭৪৭ জন। বাকি ৩,৫৩৮ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী। আওয়ামী লীগের ৯৮১ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ৪৩৮ জন, জাতীয় পার্টির ১৮৭ জন, জাকের পার্টির ৬৪ জন এবং জাসদের ২৫ জন। বাকিরা স্বতন্ত্র।

১১ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৬ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী ১৪২৫ জন, স্বতন্ত্র প্রার্থী তার দ্বিগুণের কাছাকাছি, ২৬৫৫ জন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৮৩৮ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ৩৬৮ জন, জাতীয় পার্টির ১০৭ জন।

ফাইল ছবি

আবারও কঠোর বার্তা

ইউপি নির্বাচন ধরে ঘরের সংঘাত এড়াতে কঠোর বার্তা দিয়ে জেলা, মহানগর, উপজেলা ও থানা আওয়ামী লীগের কাছে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

চিঠিতে লেখা হয়, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে পাঠানো প্রস্তাব এবং আবেদনকারীদের তথ্য-উপাত্ত যাচাই ও মাঠ জরিপের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

তাই বিদ্রোহী প্রার্থী যারা হয়েছেন, তাদের ভোটের মাঠ ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

“অন্যথায় গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারা অনুযায়ী সকল বিদ্রোহী প্রার্থী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করছি,” হুমকি দেওয়া হয় ওই চিঠিতে।

ওবায়দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে আছে, তাদের মদদদাতাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। অনেক এমপি-মন্ত্রী আছেন, যারা মদদ দিচ্ছেন, আগামীতে তারা দলীয় মনোনয়নও পাবে না। কারা কারা মদদ নিয়ে নির্বাচনে রেখেছে, তাদের সব তথ্য আমাদের কাছে আছে, আগামী নির্বাচন আসেলেই দেখতে পাবেন তারা মনোনয়ন পায়নি।”

তবে ওবায়দুল কাদের দাবি করেন, দলের অবস্থান কঠোর হওয়ায় আগের তুলনায় বিদ্রোহী প্রার্থী অনেক কমে গেছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান আশা করছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত মাঠ ছেড়ে দেবেন।

তিনি বলেন, “এখন যারা বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করছেন, তারা আবেগতাড়িত হয়েই নির্বাচন করছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সবাই নৌকার প্রার্থীর হয়ে কাজ করবেন বলেই আমি মনে করি।”

ফলে এই বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে নৌকার প্রার্থীর ‘বিপাকে থাকার কোনো কারণ নেই, বলেন তিনি।