জেল হত্যা দিবসে স্মরণে জাতীয় চার নেতা

সাড়ে চার দশক আগে কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার দিনটি নানা কর্মসূচিতে স্মরণ করছে বাংলাদেশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2021, 04:07 AM
Updated : 3 Nov 2021, 04:31 AM

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর তার ঘনিষ্ঠ চার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে কারাগারে হত্যা করা হয়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ৩ নভেম্বর কলঙ্কময় ও বেদনাবিধুর একটি দিন। রাষ্ট্রের হেফাজতে জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার দিনটি ‘জেল হত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গতবারের মত এবারও জনসমাগম সীমিত করে জেলহত্যা দিবসের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো ধারণ করেছেন শোকের কালো ব্যাজ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান

দিনটি উপলক্ষে বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ধানমণ্ডিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। পরে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পরে সকাল ৯টায় দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ওবায়দুল কাদের যান বনানী কবরস্থানে। সেখানে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে এবং পরে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলীর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাজশাহীতে কামারুজ্জামানের কবরেও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও মোনাজাতেও অংশ নেন দলের নেতাকর্মীরা।

বনানীতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, “বঙ্গবন্ধুর পর জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উগ্র সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটন করাই এখনকার চ্যালেঞ্জ। সব গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে এক হয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তির মূলোৎপাটন করতে হবে।” 

দিনের কর্মসূচির শুরুতে ভোরে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের বিভিন্ন কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়; উত্তোলন করা হয় কালো পতাকা।

যেখানে চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল, ঢাকার সেই পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগারে এখন গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘর। সকালে সেখানে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

নৃশংস সেই হত্যাকাণ্ড

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাতকারী সেনাসমর্থিত চক্রান্তকারীরাই কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করেছিল। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ইতিহাসে বিরল।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তার ঘনিষ্ঠ চার নেতাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু-পাল্টা ক্যু'র ধূম্রজালের মধ্যে ৩ নভেম্বর সংঘটিত হয় জেল হত্যাকাণ্ড।

জেলহত্যার পর ২১ বছর এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলা পুনরুজ্জীবিত করে।

১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর এ মামলায় আসামি সৈয়দ ফারুক রহমানসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তারপর বিচারিক আদালতে রায় হয়।

তবে শুধু সেনাসদস্য মোসলেউদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাই কোর্ট আপিলের রায় দেয়। ওই রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য দুই আসামি মারফত আলী এবং আবুল হোসেন মৃধাকে খালাস দেওয়া হয়।

নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, একেএম মহিউদ্দিন আহাম্মদকেও খালাস দেওয়া হয়।

হত্যাকাণ্ডের সুদীর্ঘ ২৯ বছর পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যরা এ রায়কে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রহসনের রায়’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের অভিযোগ, জেলহত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়।

২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে।

কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যামামলায় হাই কোর্টের রায়ে বাদ পড়লেও ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপিল বিভাগ দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধার মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেয়।

কাকতালীয়ভাবে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসে এই চার নেতা হত্যা মামলার চূড়ান্ত আইনি লড়াইয়ের শুনানি শেষ হয়। ১৯৭১ সালের ওই দিনে এই চার নেতার নেতৃত্বে কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে শপথ নিয়েছিল স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার।